যোগাযোগ

“আচ্ছা, তুমি তোমার ঐ গায়ের চাদরখানা খুলে ফেলো— ওটাকে আমি দেখতে পারছি নে।”

সসংকোচে কুমুদিনী চাদরখানা খুলে ফেললে। গায়ে ছিল একখানি ডুরে শাড়ি, সরু পাড়ের। কালো ডোরার ধারাগুলি কুমুদিনীর তনুদেহটিকে ঘিরে, যেন তারা রেখার ঝরনা— থেমে আছে মনে হয় না, কেবলই যেন চলছে— যেন কোনো-একটি কালো দৃষ্টি আপন অশ্রান্ত গতির চিহ্ন রেখে রেখে ওর অঙ্গকে ঘিরে ঘিরে প্রদক্ষিণ করছে, কিছুতে শেষ করতে পারছে না। মুগ্ধ হয়ে গেল মধুসূদন, অথচ সেই মুহূর্তে একটু লক্ষ্য না করে থাকতে পারলে না যে, ঐ শাড়িটি এখানকার দেওয়া নয়। কুমুদিনীকে যতই মানাক না কেন, এর দাম তুচ্ছ এবং এটা ওর বাপের বাড়ির। ঐ নাবার ঘরের সংলগ্ন কাপড় ছাড়বার ঘরে আছে দেরাজওআলা মেহগিনি কাঠের মস্ত আলমারি, তার আয়না-দেওয়া পাল্লা— বিবাহের পূর্ব হতেই নানা রকমের দামি কাপড়ে ঠাসা। সেগুলির উপরে লোভ নেই— মেয়ের এত গর্ব! মনে পড়ে গেল সেই তিনটে আংটির কথা, অসহ্য ঔদাসীন্যে তাকে কুমু গ্রহণ করে নি, অথচ একটা লক্ষ্মীছাড়া নীলার আংটির জন্যে কত আগ্রহ! বিপ্রদাস আর মধুসূদনের মধ্যে কুমুর মমতার কত মূল্যভেদ! চাদর খোলবামাত্র এই-সমস্ত কথা দমকা ঝড়ের মতো মধুসূদনকে প্রকাণ্ড ধাক্কা দিলে। কিন্তু হায় রে, কী সুন্দর, কী আশ্চর্য সুন্দর! আর এই দৃপ্ত অবজ্ঞা, সেও যেন ওর অলংকার। এই মেয়েই তো পারে ঐশ্বর্যকে অবজ্ঞা করতে। সহজ সম্পদে মহীয়সী হয়ে জন্মেছে— ওকে ধনের দাম কষতে হয় না, হিসেব রাখতে হয় না— মধুসূদন ওকে কী দিয়ে লোভ দেখাতে পারে!

মধুসূদন বললে, “যাও, তুমি শুতে যাও।”

কুমু ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল— নীরব প্রশ্ন এই যে, ‘তুমি আগে বিছানায় যাবে না?’

মধুসূদন দৃঢ়স্বরে পুনরায় বললে, “যাও, আর দেরি কোরো না।” কুমু বিছানায় যখন প্রবেশ করলে মধুসূদন সোফার উপরে বসে বললে, “এইখানেই বসে রইলুম, যদি আমাকে ডাক তবেই যাব। বৎসরের পর বৎসর অপেক্ষা করতে রাজি আছি।”

কুমুর সমস্ত গা এল ঝিম্‌ ঝিম্‌ করে— এ কী পরীক্ষা তার! কার দরজায় সে আজ মাথা কুটবে? দেবতা তো তাকে সাড়া দিলেন না। যে পথ দিয়ে সে এখানে এল সে তো একেবারেই ভুল পথ। বিছানায় বসে বসে মনে মনে সে বললে, ‘ঠাকুর, তুমি আমাকে কখনো ভোলাতে পার না, এখনো তোমাকে বিশ্বাস করব। ধ্রুবকে তুমিই বনে এনেছিলে, বনের মধ্যে তাকে দেখা দেবে বলে।’

সেই নিস্তব্ধ ঘরে আর শব্দ নেই; রাস্তার মোড়ে সেই মাতালটার গলা শোনা যায় না; কেবল সেই বন্দী কুকুরটা যদিও শ্রান্ত তবু মাঝে মাঝে আর্তনাদ করে উঠছে।

অল্প সময়কেও অনক সময় বলে মনে হল, স্তব্ধতার ভারগ্রস্ত প্রহর যেন নড়তে পারছে না। এই কি তার দাম্পত্যের অনন্তকালের ছবি? দু পারে দুজনে নীরবে বসে— রাত্রির শেষ নেই— মাঝখানে একটা অলঙ্ঘনীয় নিস্তব্ধতা! অবশেষে এক সময় কুমু তার সমস্ত শক্তিকে সংহত করে নিয়ে বিছানা থেকে বেরিয়ে এসে বললে, “আমাকে অপরাধিনী কোরো না।”

মধুসূদন গভীরকণ্ঠে বললে, “কী চাও বলো, কী করতে হবে?” শেষ কথাটুকু পর্যন্ত একেবারে নিংড়ে বের করে নিতে চায়।

কুমু বললে, “শুতে এসো।”

কিন্তু একেই কি বলে জিত?