শেষের কবিতা

“আর আমার নিমন্ত্রণ বুঝি বন্ধ? আমি একঘরে?”

“তোমার নিমন্ত্রণ মাসে একদিন, পূর্ণিমার রাতে– চোদ্দটা তিথির খণ্ডতা যেদিন চরম পূর্ণ হয়ে উঠবে।”

“এইবার তোমার প্রিয়শিষ্যাকে একটি চিঠির নমুনা দাও।”

“আচ্ছা বেশ।” পকেট থেকে একটা নোট-বই বের করে তার পাতা ছিঁড়ে লিখলে—

"Blow gently over my garden
      Wind of the southern sea.
In the hour my love cometh
‍       And calleth me.
      চুমিয়া যেয়ো তুমি
      আমার বনভূমি,
         দখিন-সাগরের সমীরণ,
      যে শুভখনে মম
      আসিবে প্রিয়তম–
         ডাকিবে নাম ধরে অকারণ।”

লাবণ্য কাগজখানা ফিরিয়ে দিলে না।

অমিত বললে, “এবারে তোমার চিঠির নমুনা দাও, দেখি, তোমার শিক্ষা কতদূর এগোল!”

লাবণ্য একটা টুকরো কাগজে লিখতে যাচ্ছিল। অমিত বললে, “না, আমার এই নোট-বইয়ে লেখো।”

লাবণ্য লিখে দিলে—

“মিতা, ত্বমসি মম জীবনং, ত্বমসি মম ভূষণং,
          ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নম্‌।”

অমিত বইটা পকেটে পুরে বললে, “আশ্চর্য এই, আমি লিখেছি মেয়ের মুখের কথা, তুমি লিখেছ পুরুষের। কিছুই অসংগত হয় নি, শিমুলকাঠই হোক আর বকুলকাঠই হোক, যখন জ্বলে তখন আগুনের চেহারাটা একই।”

লাবণ্য বললে, “নিমন্ত্রণ তো করা গেল, তার পরে?”

অমিত বললে, “সন্ধ্যাতারা উঠেছে, জোয়ার এসেছে গঙ্গায়, হাওয়া উঠল ঝি‍‍র‍্‍ঝির্ করে ঝাউগাছগুলোর সার বেয়ে, বুড়ো বটগাছটার শিকড়ে শিকড়ে উঠল স্রোতের ছল্‌ছলানি। তোমার বাড়ির পিছনে পদ্মদিঘি, সেইখানে খিড়কির নির্জন ঘাটে গা ধুয়ে চুল বেঁধেছ। তোমার এক-একদিন এক-এক রঙের কাপড়, ভাবতে ভাবতে যাব আজকে সন্ধেবেলার রঙটা কী। মিলনের জায়গারও ঠিক নেই, কোনোদিন শান-বাঁধানো চাঁপাতলায়, কোনোদিন বাড়ির ছাতে, কোনোদিন গঙ্গার ধারের চাতালে। আমি গঙ্গায় স্নান সেরে সাদা মলমলের ধুতি আর চাদর পরব, পায়ে থাকবে হাতির-দাঁতে-কাজ-করা খড়ম। গিয়ে দেখব, গালচে বিছিয়ে বসেছ, সামনে রুপোর রেকাবিতে মোটা গোড়ে মালা, চন্দনের বাটিতে চন্দন, এক কোণে জ্বলছে ধূপ। পুজোর সময় অন্তত দু মাসের জন্যে দুজনে বেড়াতে বেরোব। কিন্তু দুজনে দু জায়গায়। তুমি যদি যাও পর্বতে, আমি যাব সমুদ্রে।– এই তো আমার দাম্পত্য দ্বৈরাজ্যের নিয়মাবলী তোমার কাছে দাখিল করা গেল। এখন তোমার কী মত?”

“মেনে নিতে রাজি আছি।”