প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
তখনই কুমু তিনটে আংটি খুলে টিপায়ের উপর রাখলে।
মধুসূদন ধমক দিয়ে বললে, “যাও চলে।”
কুমু তখনই চলে গেল।
এইবার মধুসূদন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলে যে, সে আপিসে যাবেই। তখন কাজের সময় প্রায় উত্তীর্ণ। ইংরেজ কর্মচারীরা সকলেই চলে গেছে টেনিস খেলায়। উচ্চতন বড়োবাবুদের দল উঠি-উঠি করছে। এমন সময় মধুসূদন আপিসে উপস্থিত হয়ে একেবারে খুব কষে কাজে লেগে গেল। ছটা বাজল, সাতটা বাজল, আটটা বাজে, তখন খাতাপত্র বন্ধ করে উঠে পড়ল।
এতদিন মধুসূদনের জীবনযাত্রায় কখনো কোনো খেই ছিঁড়ে যেত না। প্রতি দিনের প্রতি মুহূর্তই নিশ্চিত নিয়মে বাঁধা ছিল। আজ হঠাৎ একটা অনিশ্চিত এসে সব গোলমাল বাধিয়ে দিয়েছে। এই-যে আজ আপিস থেকে বাড়ির দিকে চলেছে, রাত্তিরটা যে ঠিক কী ভাবে প্রকাশ পাবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। মধুসূদন ভয়ে ভয়ে বাড়িতে এল, আস্তে আস্তে আহার করলে। আহার করে তখনই সাহস হল না শোবার ঘরে যেতে। প্রথমে কিছুক্ষণ বাইরের দক্ষিণের বারান্দায় পায়চারি করে বেড়াতে লাগল। শোবার সময় ন-টা যখন বাজল তখন গেল অন্তঃপুরে। আজ ছিল দৃঢ় পণ— যথাসময়ে বিছানায় শোবে, কিছুতেই অন্যথা হবে না। শূন্য শোবার ঘরে ঢুকেই মশারি খুলেই একেবারে ঝপ্ করে বিছানার উপরে পড়ল। ঘুম আসতে চায় না। রাত্রি যতই নিবিড় হয় ততই ভিতরকার উপবাসী জীবটা অন্ধকারে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। তখন তাকে তাড়া করবার কেউ নেই, পাহারাওয়ালারা সকলেই ক্লান্ত।
ঘড়িতে একটা বাজল, চোখে একটুও ঘুম নেই; আর থাকতে পারল না, বিছানা থেকে উঠে ভাবতে লাগল কুমু কোথায়? বঙ্কু ফরাশের উপর কড়া হুকুম, ফরাশখানা তালাচাবি দিয়ে বন্ধ। ছাদ ঘুরে এল, কেউ নেই। পায়ের জুতো খুলে ফেলে নীচের তলায় বারান্দা বেয়ে ধীরে ধীরে চলতে লাগল। মোতির মার ঘরের সামনে এসে মনে হল যেন কথার্বাতার শব্দ। হতে পারে, কাল চলে যাবে, আজ স্বামীস্ত্রীতে পরামর্শ চলছে। বাইরে চুপ করে দরজায় কান পেতে রইল। দুজনে গুন্ গুন্ করে আলাপ চলছে। কথা শোনা যায় না, কিন্তু স্পষ্টই বোঝা গেল দুটিই মেয়ের গলা। তবে তো বিচ্ছেদের পূর্বরাত্রে মোতির মায়ের সঙ্গে কুমুরই মনের কথা হচ্ছে। রাগে ক্ষোভে ইচ্ছে করতে লাগল লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলে একটা কাণ্ড করে। কিন্তু নবীনটা তা হলে কোথায়? নিশ্চয়ই বাইরে।
অন্তঃপুর থেকে বাইরে যাবার ঝিলমিল-দেওয়া রাস্তাটাতে লণ্ঠনে একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে, সেইখানে এসেই মধুসূদন দেখলে একখানা লাল শাল গায়ে জড়িয়ে শ্যামা দাঁড়িয়ে। তার কাছে লজ্জিত হয়ে মধুসূদন রেগে উঠল। বললে, “কী করছ এত রাত্রে এখানে?”
শ্যামা উত্তর করলে, “শুয়েছিলুম। বাইরে পায়ের শব্দ শুনে ভয় হল, ভাবলুম বুঝি—”
মধুসূদন তর্জন করে বলে উঠল, “আস্পর্ধা বাড়ছে দেখছি। আমার সঙ্গে চালাকি করতে চেয়ো না, সাবধান করে দিচ্ছি। যাও শুতে।”
শ্যামাসুন্দরী কয়দিন থেকে একটু একটু করে তার সাহসের ক্ষেত্র বাড়িয়ে বাড়িয়ে চলছিল। আজ বুঝলে, অসময়ে অজায়গায় পা পড়েছে। অত্যন্ত করুণ মুখ করে একবার সে মধুসূদনের দিকে চাইলে, তার পরে মুখ ফিরিয়ে আঁচলটা টেনে চোখ মুছলে। চলে