যোগাযোগ

“কী বল দিদি, তার ঠিক নেই। সংসারখরচের যে টাকা আমার কাছে থাকে, সে তো তোমারই টাকা। আজ থেকে আমি যে তোমারই নিমক খাচ্ছি।”

কুমু জোর করে বলে উঠল, “না না না, এ বাড়ির কিছুই আমার নয়, সিকি পয়সাও না।”

“আচ্ছা ভাই, তোমার জন্যে না হয় আমার নিজের টাকা থেকে কিছু খরচ করব। চুপ করে রইলে কেন? তাতে দোষ কী? টাকাটা আমি যদি অহংকার করে দিতুম, তুমি অহংকার করে না নিতে পারতে। ভালোবেসে যদি দিই, তা হলে ভালোবেসেই নেবে না কেন?”

কুমু বললে, “নেব।”

মোতির মা জিজ্ঞাসা করলে, “দিদি, তোমার শোবার ঘর কি আজও শূন্য থাকবে?”

কুমু বললে, “ওখানে আমার জায়গা নেই।”

মোতির মা পীড়াপীড়ি করলে না। তার মনের ভাবখানা এই যে, পীড়াপীড়ি করবার ভার আমার নয়; যার কাজ সে করুক। কেবল আস্তে আস্তে সে বললে, “একটু দুধ এনে দেব তোমার জন্যে?”

কুমু বললে, “এখন না, আর একটু পরে।” তার ঠাকুরের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে এখনো বাকি আছে। এখনো মনের মধ্যে কোনো জবাব পাচ্ছে না।

মোতির মা আপন ঘরে গিয়ে নবীনকে ডেকে বললে, “শোনো একটি কথা। বড়োঠাকুরের বাইরের ঘরে তাঁর ডেস্কের উপর খোঁজ করে এসো গে, দিদির কোনো চিঠি এসেছে কিনা— দেরাজ খুলেও দেখো।”

নবীন বললে, “সর্বনাশ!”

“তুমি যদি না যাও তো আমি যাব।”

“এ যে ঝোপের ভিতর থেকে ভালুকের ছানা ধরতে পাঠানো”!

“কর্তা গেছেন আপিসে, তাঁর কাজ সেরে আসতে বেলা একটা হবে— এর মধ্যে— ”

“দেখো মেজোবউ, দিনের বেলায় এ কাজ কিছুতেই আমার দ্বারা হবে না, এখন চারি দিকে লোকজন। আজ রাত্রে তোমাকে খবর দিতে পারব।”

মোতির মা বললে, “আচ্ছা, তাই সই। কিন্তু নুরনগরে এখনই তার করে জানতে হবে বিপ্রদাসবাবু কেমন আছেন।”

“বেশ কথা, তা দাদাকে জানিয়ে করতে হবে তো?”

“না।”

“মেজোবউ, তুমি যে দেখি মরিয়া হয়ে উঠেছ! এ বাড়িতে টিকটিকি মাছি ধরতে পারে না কর্তার হুকুম ছাড়া, আর আমি— ”

“দিদির নামে তার যাবে তোমার তাতে কী?”

“আমার হাত দিয়ে তো যাবে।”

“বড়োঠাকুরের আপিসে ঢের তার তো রোজ দরোয়ানকে দিয়ে পাঠানো হয়, তার সঙ্গে এটা চালান দিয়ো। এই নাও টাকা, দিদি দিয়েছেন।”

কুমুর সম্বন্ধে নবীনের মনও যদি করুণায় ব্যথিত না থাকত তা হলে এতবড়ো দুঃসাহসিক কাজের ভার সে কিছুতেই নিতে পারত না।