যোগাযোগ

ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে কুমু বললে, “দেখো ভাই, নিজেকে দেব বলেই তৈরি হয়ে এসেছিলুম, কিন্তু ও কিছুতেই দিতে দিলে না। এখন দাসী নিয়েই থাকুক। আমাকে পাবে না।”

মোতির মা বললে, “কাঠুরে গাছকে কাটতেই জানে, সে গাছ পায় না, কাঠ পায়। মালী গাছকে রাখতে জানে, সে পায় ফুল, পায় ফল। তুমি পড়েছ কাঠুরের হাতে, ও যে ব্যাবসাদার। ওর মনে দরদ নেই কোথাও।”

এক সময়ে শোবার ঘরে ফিরে এসে কুমু দেখলে, তার টিপাইয়ের উপর একশিশি লজেঞ্জস। হাবলু তার ত্যাগের অর্ঘ্য গোপনে নিবেদন করে নিজে কোথায় লুকিয়েছে। এখানে পাষাণের ফাঁক দিয়েও ফুল ফোটে। বালকের এই লজেঞ্জসের ভাষায় একসঙ্গে ওকে কাঁদালে হাসালে। তাকে খুঁজতে বেরিয়ে দেখে বাইরে সে দরজার আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। মা তাকে এ ঘরে যাতায়াত করতে বারণ করেছিল। তার ভয় ছিল পাছে কোনো কিছু উপলক্ষে কর্তার বিরক্তি ঘটে। মোটের উপরে মধুসূদনের নিজের কাজ ছাড়া অন্য বাবদে তার কাছ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকাই নিরাপদ, এ কথা এ বাড়ির সবাই জানে।

কুমু হাবলুকে ধরে ঘরে নিয়ে এসে কোলে বসালে। ওর গৃহসজ্জার মধ্যে পুতুল-জাতীয় যা-কিছু জিনিস ছিল সেইগুলো দুজনে নাড়াচাড়া করতে লাগল। কুমু বুঝতে পারলে একটা কাগজচাপা হাবলুর ভারি পছন্দ—কাঁচের ভিতর দিয়ে রঙিন ফুল যে কী করে দেখা যাচ্ছে সেইটে বুঝতে না পেরে ওর ভারি তাক লেগেছে।

কুমু বললে, “এটা নেবে গোপাল?”

এতবড়ো অভাবনীয় প্রস্তাব ওর বয়সে কখনো শোনে নি। এমন জিনিসও কি ও কখনো আশা করতে পারে? বিস্ময়ে সংকোচে কুমুর মুখের দিকে নীরবে চেয়ে রইল।

কুমু বললে, “এটা তুমি নিয়ে যাও।”

হাবলু আহ্লাদ রাখতে পারলে না— সেটা হাতে নিয়েই লাফাতে লাফাতে ছুটে চলে গেল।

সেইদিন বিকেলে হাবলুর মা এসে বললে, “তুমি করেছ কী ভাই? হাবলুর হাতে কাঁচের কাগজচাপা দেখে বড়োঠাকুর হুলস্থুল বাধিয়ে দিয়েছে। কেড়ে তো নিয়েইছে— তার পর তাকে চোর বলে মার। ছেলেটাও এমনি, তোমার নামও করে নি। হাবলুকে আমিই যে জিনিসপত্র চুরি করতে শেখাচ্ছি এ কথাও ক্রমে উঠবে।”

কুমু কাঠের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে বসে রইল।

এমন সময়ে বাইরে মচ্‌মচ্‌ শব্দে মধুসূদন আসছে। মোতির মা তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল। মধুসূদন কাঁচের কাগজচাপা হাতে করে যথাস্থানে ধীরে ধীরে সেটা গুছিয়ে রাখলে। তার পরে নিশ্চিতপ্রত্যয়ের কণ্ঠে শান্ত গম্ভীর স্বরে বললে, “হাবলু তোমার ঘর থেকে এটা চুরি করে নিয়েছিল। জিনিসপত্র সাবধান করে রাখতে শিখো।”

কুমু তীক্ষ্ম স্বরে বললে, “ও চুরি করে নি।”

“আচ্ছা, বেশ, তা হলে সরিয়ে নিয়েছে।”

“না, আমিই ওকে দিয়েছি।”

“এমনি করে ওর মাথা খেতে বসেছ বুঝি? একটা কথা মনে রেখো, আমার হুকুম ছাড়া জিনিসপত্র কাউকে দেওয়া চলবে না। আমি এলোমেলো কিছুই ভালোবাসি নে।”

কুমু দাঁড়িয়ে উঠে বললে, “তুমি নাও নি আমার নীলার আংটি?”

মধুসূদন বললে, “হাঁ নিয়েছি।”

“তাতেও তোমার ঐ কাঁচের ঢেলাটার দাম শোধ হল না?”