যোগাযোগ
বুঝলে, সময়ে অসময়ে সিঁথি কণ্ঠহার বালা বাজুর যোগে অভিমানিনীর সঙ্গে ব্যবহারের সোজা পথ পাওয়া যাবে— এই পথে মধুসূদনের প্রভাব না মেনে উপায় নেই, বয়স না-হয় কিছু বেশিই হল।

নিজের হাত থেকে মস্তবড়ো কমলহীরের একটি আংটি খুলে নিয়ে মধুসূদন হেসে বললে, “ভয় নেই, এর বদলে আর-একটা আংটি তোমাকে পরিয়ে দিচ্ছি।”

কুমু আর থাকতে পারলে না, একটু চেষ্টা করেই হাত ছাড়িয়ে নিলে। এইবার মধুসূদনের মনটা ঝেঁকে উঠল। কর্তৃত্বের খর্বতা তাকে সইবে না, শুষ্ক গলায় জোর করেই বলল, “দেখো, এ আংটি তোমাকে খুলতেই হবে।”

কুমুদিনী মাথা হেঁট করে চুপ করে রইল, তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে।

মধুসূদন আবার বললে, “শুনছ? আমি বলছি ওটা খুলে ফেলা ভালো। দাও আমাকে।” বলে হাতটা টেনে নিতে উদ্যত হল।

কুমু হাত ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “আমি খুলছি।”

খুলে ফেললে।

“দাও, ওটা আমাকে দাও।”

কুমুদিনী বললে, “ওটা আমিই রেখে দেব।”

মধুসূদন বিরক্ত হয়ে হেঁকে উঠল, “রেখে লাভ কী? মনে ভাবছ, এটা ভারি একটা দামি জিনিস! এ কিছুতেই তোমার পরা চলবে না, বলে দিচ্ছি।”

কুমুদিনী বললে, “আমি পরব না।” বলে সেই পুঁতির কাজ-করা থলেটির মধ্যে আংটি রেখে দিলে।

“কেন, এই সামান্য জিনিসটার উপরে এত দরদ কেন? তোমার তো জেদ কম নয়!”

মধুসূদনের আওয়াজটা খরখরে; কানে বাজে, যেন বেলে-কাগজের ঘর্ষণ। কুমুদিনীর সমস্ত শরীরটা রী রী করে উঠল।

“এ আংটি তোমাকে দিলে কে?”

কুমুদিনী চুপ করে রইল।

“তোমার মা নাকি?”

নিতান্তই জবাব দিতে হবে বলেই অর্ধস্ফুটস্বরে বললে, “দাদা।”

দাদা! সে তো বোঝাই যাচ্ছে। দাদার দশা যে কী, মধুসূদন তা ভালোই জানে। সেই দাদার আংটি শনির সিঁধকাঠি— এ ঘরে আনা চলবে না। কিন্তু তার চেয়েও ওকে এইটেই খোঁচা দিচ্ছে যে, এখনো কুমুদিনীর কাছে ওর দাদাই সব চেয়ে বেশি। সেটা স্বাভাবিক বলেই যে সেটা সহ্য হয় তা নয়। পুরোনো জমিদারের জমিদারি নতুন ধনী মহাজন নিলেমে কেনার পর ভক্ত প্রজারা যখন সাবেক আমলের কথা স্মরণ করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে থাকে তখন আধুনিক অধিকারীর গায়ের জ্বালা ধরে, এও তেমনি। আজ থেকে আমিই যে ওর একমাত্র, এই কথাটা যত শীঘ্র হোক ওকে জানান দেওয়া চাই। তা ছাড়া গায়ে-হলুদের খাওয়ানো নিয়ে বরের যা অপমান হয়েছে তাতে বিপ্রদাস নেই এ কথা মধুসূদন বিশ্বাস করতেই পারে না। যদিও নবগোপাল বিবাহের পরদিনে ওকে বলেছিল, “ভায়া, বিয়েবাড়িতে তোমাদের হাটখোলার আড়ত থেকে যে-চালচলনের আমদানি করেছিলে, সে কথাটা ইঙ্গিতেও দাদাকে জানিয়ো না; উনি এর কিছুই জানেন না, ওঁর শরীরও বড়ো খারাপ।”

আংটির কথাটা আপাতত স্থগিত রাখলে, কিন্তু মনে রইল।

এ দিকে রূপ ছাড়া আরো একটা কারণে হঠাৎ কুমুদিনীর দর বেড়ে গিয়েছে। নুরনগরে থাকতেই ঠিক বিবাহের দিনে মধুসূদন টেলিগ্রাফ পেয়েছে যে, এবার তিসি চালানের কাজে লাভ হয়েছে প্রায় বিশ লাখ টাকা। সন্দেহ রইল না, এটা নতুন বধূর পয়ে।