যোগাযোগ
আনমনে একা বসে করেছে পশম সেলাই। ঋতুতে ঋতুতে মাসে মাসে প্রকৃতির উৎসবের সঙ্গে মানুষের এক-একটি পরব বাঁধা। অক্ষয়তৃতীয়া থেকে দোলযাত্রা বাসন্তীপুজো পর্যন্ত কত কী। মানুষে প্রকৃতিতে হাত মিলিয়ে সমস্ত বছরটিকে যেন নানা কারুশিল্পে বুনে তুলছে। সবই যে সুন্দর, সবই যে সুখের তা নয়। মাছের ভাগ, পুজোর পার্বণী, কর্ত্রীর পক্ষপাত, ছেলেদের কলহে স্ব-স্ব ছেলের পক্ষসমর্থন প্রভৃতি নিয়ে নীরবে ঈর্ষা বা তারস্বরে অভিযোগ, কানে কানে পরচর্চা বা মুক্তকণ্ঠে অপবাদঘোষণা, এ-সমস্ত প্রচুর পরিমাণেই আছে— সব চেয়ে আছে নিত্যনৈমিত্তিক কাজের ব্যস্ততার ভিতরে ভিতরে নিয়ত একটা উদ্‌‍বেগ— কর্তা কখন কী করে বসেন, তাঁর বৈঠকে কখন কী দুর্যোগ আরম্ভ হয়। যদি আরম্ভ হল তবে দিনের পর দিন শান্তি নেই। কুমুদিনীর বুক দুর্ দুর্ করে, ঘরে লুকিয়ে মা কাঁদেন, ছেলেদের মুখ শুকনো। এই-সমস্ত শুভে অশুভে সুখে দুঃখে সর্বদা আন্দোলিত প্রকাণ্ড সংসারযাত্রা।

এরই মধ্যে থেকে কুমুদিনী এল কলকাতায়। এ যেন মস্ত একটা সমুদ্র কিন্তু কোথায় একফোঁটা পিপাসার জল? দেশে আকাশের বাতাসেরও একটা চেনা চেহারা ছিল। গ্রামের দিগন্তে কোথাও-বা ঘন বন, কোথাও-বা বালির চর, নদীর জলরেখা, মন্দিরের চুড়ো, শূন্য বিস্তৃত মাঠ, বুনো ঝাউয়ের ঝোপ, গুণটানা পথ— এরা নানা রেখায় নানা রঙে বিচিত্র ঘের দিয়ে আকাশকে একটি বিশেষ আকাশ করে তুলেছিল— কুমুদিনীর আপন আকাশ। সূর্যের আলোও ছিল তেমনি বিশেষ আলো। দিঘিতে, শস্যখেতে, বেতের ঝাড়ে, জেলে-নৌকোর খয়েরি রঙের পালে, বাঁশঝাড়ের কচি ডালের চিকন পাতায়, কাঁঠালগাছের মসৃণ ঘন সবুজে, ও পারের বালুতটের ফ্যাকাশে হলদে— সমস্তর সঙ্গে নানা ভাবে মিশিয়ে সেই আলো একটি চিরপরিচিত রূপ পেয়েছিল। কলকাতার এই-সব অপরিচিত বাড়ির ছাদে দেয়ালে কঠিন অনম্র রেখার আঘাতে নানাখানা হয়ে সেই চিরদিনের আকাশ আলো তাকে বেগানা লোকের মতো কড়া চোখে দেখে। এখানকার দেবতাও তাকে একঘরে করেছে।

বিপ্রদাস তাকে কেদারার কাছে টেনে নিয়ে বলে, “কী কুমু, মন কেমন করছে?”

কুমুদিনী হেসে বলে, “না দাদা, একটুও না।”

“যাবি বোন, ম্যুজিয়ম দেখতে?”

“হ্যাঁ, যাব।”

এত বেশি উৎসাহের সঙ্গে বলে যে, বিপ্রদাস যদি পুরুষমানুষ না হত তবে বুঝতে পারত যে এটা স্বাভাবিক নয়। ম্যুজিয়মে না যেতে হলেই সে বাঁচে। বাইরের লোকের ভিড়ের মধ্যে বেরোনো অভ্যেস নেই বলে জনসমাগমে যেতে তার সংকোচের অন্ত নেই। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, চোখ চেয়ে ভালো করে দেখতেই পারে না।

বিপ্রদাস তাকে দাবাখেলা শেখালে। নিজে অসামান্য খেলোয়াড়, কুমুর কাঁচা খেলা নিয়ে তার আমোদ লাগে। শেষকালে নিয়মিত খেলতে খেলতে কুমুর এতটা হাত পাকল যে বিপ্রদাসকে সাবধানে খেলতে হয়। কলকাতায় কুমুর সমবয়সী মেয়েসঙ্গিনী না থাকাতে এই দুই ভাইবোন যেন দুই ভাইয়ের মতো হয়ে উঠেছে। সংস্কৃত সাহিত্যে বিপ্রদাসের বড়ো অনুরাগ; কুমু একমনে তার কাছ থেকে ব্যাকরণ শিখেছে। যখন কুমারসম্ভব পড়লে তখন থেকে শিবপূজায় সে শিবকে দেখতে পেলে, সেই মহাতপস্বী যিনি তপস্বিনী উমার পরম তপস্যার ধন। কুমারীর ধ্যানে তার ভাবী পতি পবিত্রতার দৈবজ্যোতিতে উদ্‌ভাসিত হয়ে দেখা দিলে।

বিপ্রদাসের ফোটোগ্রাফ তোলার শখ, কুমুও তাই শিখে নিলে। ওরা কেউ-বা নেয় ছবি, কেউ-বা সেটাকে ফুটিয়ে তোলে। বন্দুকে বিপ্রদাসের হাত পাকা। পার্বণ উপলক্ষে দেশে যখন যায়, খিড়কির পুকুরে ডাব, বেলের খোলা, আখরোট প্রভৃতি ভাসিয়ে দিয়ে পিস্তল অভ্যাস করে; কুমুকে ডাকে, “আয় না কুমু, দেখ্‌-না চেষ্টা করে।”

যে-কোনো বিষয়েই তার দাদার রুচি সে-সমস্তকেই বহু যত্নে কুমু আপনার করে নিয়েছে। দাদার কাছে এসরাজ শিখে শেষে ওর হাত এমন হল যে দাদা বলে, আমি হার মানলুম।