পণরক্ষা

রসিকের ভক্তশ্রেষ্ঠ গোপাল আজকাল অভিমান করিয়া দূরে দূরে থাকে। রসিকের সামনে দিয়া তাহাকে দেখাইয়া দেখাইয়া একাই মাছ ধরিতে যায়, আগেকার মতো তাহাকে ডাকাডাকি করে না। আর, সৌরভীর তো কথাই নাই। রসিকদাদার সঙ্গে তাহার আড়ি, একেবারে জন্মের মতো আড়ি— অথচ সে যে এতবড়ো একটা ভয়ংকর আড়ি করিয়াছে সেটা রসিককে স্পষ্ট করিয়া জানাইবার সুযোগ না পাইয়া আপনার মনে ঘরের কোণে অভিমানে ক্ষণে ক্ষণে কেবলই তাহার দুই চোখ ভরিয়া উঠিতে লাগিল।

এমন সময়ে একদিন রসিক মধ্যাহ্নে গোপালদের বাড়িতে গিয়া তাহাকে ডাক দিল। আদর করিয়া তাহার কান মলিয়া দিল, তাহাকে কাতুকুতু দিতে লাগিল। গোপাল প্রথমটা প্রবল আপত্তি প্রকাশ করিয়া লড়াইয়ের ভাব দেখাইল, কিন্তু বেশিক্ষণ সেটা রাখিতে পারিল না; দুইজনে বেশ হাস্যালাপ জমিয়া উঠিল। রসিক কহিল, “গোপাল, আমার হার্মোনিয়মটি নিবি? ”

হার্মোনিয়ম! এতবড়ো দান! কলির সংসারে এও কি কখনো সম্ভব! কিন্তু যে জিনিসটা তাহার ভালো লাগে, বাধা না পাইলে সেটা অসংকোচে গ্রহণ করিবার শক্তি গোপালের যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। অতএব হার্মোনিয়মটি সে অবিলম্বে অধিকার করিয়া লইল, বলিয়া রাখিল, “ফিরিয়া চাহিলে আর কিন্তু পাইবে না।”

গোপালকে যখন রসিক ডাক দিয়াছিল তখন নিশ্চয় জানিয়াছিল সে ডাক অন্তত আরো একজনের কানে গিয়া পৌঁছিয়াছে। কিন্তু বাহিরে আজ তাহার কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না। তখন রসিক গোপালকে বলিল, “সৈরি কোথায় আছে একবার ডাকিয়া আন তো।”

গোপাল ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “সৈরি বলিল তাহাকে এখন বড়ি শুকাইতে দিতে হইবে, তাহার সময় নাই।” রসিক মনে মনে হাসিয়া কহিল, “চল্‌ দেখি, সে কোথায় বড়ি শুকাইতেছে।” রসিক আঙিনার মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিল, কোথাও বাড়ির নামগন্ধ নাই। সৌরভী তাহাদের পায়ের শব্দ পাইয়া আর-কোথাও লুকাইবার উপায় না দেখিয়া তাহাদের দিকে পিঠ করিয়া মাটির প্রাচীরের কোণ ঠেসিয়া দাঁড়াইল। রসিক তাহার কাছে গিয়া তাহাকে ফিরাইবার চেষ্টা করিয়া বলিল, “রাগ করেছিস সৈরি? ” সে আঁকিয়া-বাঁকিয়া রসিকের চেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করিয়া দেয়ালের দিকেই মুখ করিয়া রহিল।

একদা রসিক আপন খেয়ালে নানা রঙের সুতো মিলাইয়া নানা চিত্রবিচিত্র করিয়া একটা কাঁথা সেলাই করিতেছিল। মেয়েরা যে কাঁথা সেলাই করিত তাহার কতকগুলা বাঁধা নকশা ছিল— কিন্তু রসিকের সমস্তই নিজের মনের রচনা। যখন এই সেলাইয়ের ব্যাপার চলিতেছিল তখন সৌরভী আশ্চর্য হইয়া একমনে তাহা দেখিত— সে মনে করিত, জগতে কোথাও এমন আশ্চর্য কাঁথা আজ পর্যন্ত রচিত হয় নাই। প্রায় যখন কাঁথা শেষ হইয়া আসিয়াছে এমন সময়ে রসিকের বিরক্তি বোধ হইল, সে আর শেষ করিল না। ইহাতে সৌরভী মনে ভারি পীড়া বোধ করিয়াছিল— এইটে শেষ করিয়া ফেলিবার জন্য সে রসিককে কতবার যে কত সানুনয় অনুরোধ করিয়াছে তাহার ঠিক নাই- আর ঘণ্টা দুই-তিন বসিলেই শেষ হইয়া যায়, কিন্তু রসিকের যাহাতে গা লাগে না তাহাতে তাহাকে প্রবৃত্ত করাইতে কে পারে। হঠাৎ এতদিন পরে রসিক কাল রাত্রি জাগিয়া সেই কাঁথাটি শেষ করিয়াছে।

রসিক বলিল, “সৈরি, সেই কাঁথাটা শেষ করিয়াছি, একবার দেখবি না? ”

অনেক কষ্টে সৌরভীর মুখ ফিরাইতেই সে আঁচল দিয়া মুখ ঝাঁপিয়া ফেলিল। তখন যে তাহার দুই কপোল বাহিয়া জল পড়িতেছিল, সে জল সে দেখাইবে কেমন করিয়া।

সৌরভীর সঙ্গে তাহার পূর্বের সহজ সম্বন্ধ স্থাপন করিতে রসিকের যথেষ্ট সময় লাগিল। অবশেষে উভয়পক্ষে সন্ধি যখন এতদূর অগ্রসর হইল যে সৌরভী রসিককে পান আনিয়া দিল তখন রসিক সেই কাঁথার আবরণ খুলিয়া সেটা আঙিনার উপর মেলিয়া