পণরক্ষা
বিষয়েই রসিকের এমন একটি আশ্চর্য নৈপুণ্য ছিল যে তাহার চেয়ে উচ্চবংশের ছেলেরাও তাহাকে খাতির না করিয়া থাকিতে পারিত না। সে যাহাতে হাত দেয় তাহাই অতি সুকৌশলে করিতে পারে। তাহার মনের উপর যেন কোনো পূর্বসংস্কারের মূঢ়তা চাপিয়া নাই, সেইজন্য সে যাহা দেখে তাহাই গ্রহণ করিতে পারে।

রসিকের এই কারুনৈপুণ্যের জন্য তাহার কাছে ছেলেমেয়েরা, এমন-কি, তাহাদের অভিভাবকেরা পর্যন্ত উমেদারি করিত। কিন্তু তাহার দোষ ছিল কি, কোনো একটা কিছুতে সে বেশিদিন মন দিতে পারিত না। একটা কোনো বিদ্যা আয়ত্ত করিলেই আর সেটা তাহার ভালো লাগিত না— তখন তাহাকে সে বিষয়ে সাধ্যসাধনা করিতে গেলে সে বিরক্ত হইয়া উঠিত। বাবুদের বাড়িতে দেওয়ালির উৎসবে কলিকাতা হইতে আতসবাজিওয়ালা আসিয়াছিল— তাহাদের কাছ হইতে সে বাজি তৈরি শিখিয়া কেবল দুটো বৎসর পাড়ার কালীপুজোর উৎসবকে জ্যোতির্ময় করিয়া তুলিয়াছিল; তৃতীয় বৎসরে কিছুতেই আর তুবড়ির ফোয়ারা ছুটিল না— রসিক তখন চাপকান-জোব্বা-পরা মেডেল-ঝোলানো এক নব্য যাত্রাওয়ালার দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হইয়া বাক্স-হার্মোনিয়ম লইয়া লক্ষ্মৌ ঠুংরি সাধিতেছিল।

তাহার ক্ষমতার এই খামখেয়ালি লীলায় কখনো সুলভ কখনো দুর্লভ হইয়া সে লোককে আরো বেশি মুগ্ধ করিত, তাহার নিজের দাদার তো কথাই নাই। দাদা কেবলই ভাবিত, এমন আশ্চর্য ছেলে আমাদের ঘরে আসিয়া জন্মিয়াছে, এখন কোনোমতে বাঁচিয়া থাকিলে হয়— এই ভাবিয়া নিতান্ত অকারণেই তাহার চোখে জল আসিত এবং মনে মনে রাধানাথের কাছে ইহাই প্রার্থনা করিত যে আমি যেন উহার আগে মরিতে পারি।

এমনতরো ক্ষমতাশালী ভাইয়ের নিত্যনূতন শখ মিটাইতে গেলে ভাবী বধূ কেবলই দূরতর ভবিষ্যতে অন্তর্ধান করিতে থাকে, অথচ বয়স চলিয়া যায় অতীতের দিকেই। বংশীর বয়স যখন ত্রিশ পার হইল, টাকা যখন একশতও পুরিল না এবং সেই মেয়েটি অন্যত্র শ্বশুরঘর করিতে গেল তখন বংশী মনে মনে কহিল, আমার আর বড়ো আশা দেখি না, এখন বংশরক্ষার ভার রসিককেই লইতে হইবে।

পাড়ায় যদি স্বয়ম্বর-প্রথা চলিত থাকিত তবে রসিকের বিবাহের জন্য কাহাকেও ভাবিতে হইত না। বিধু, তারা, ননী, শশী, সুধা— এমন কত নাম করিব— সবাই রসিককে ভালোবাসিত। রসিক যখন কাদা লইয়া মাটির মূর্তি গড়িবার মেজাজে থাকিত তখন তাহার তৈরি পুতুলের অধিকার লইয়া মেয়েদের মধ্যে বন্ধুবিচ্ছেদের উপক্রম হইত। ইহাদের মধ্যে একটি মেয়ে ছিল, সৌরভী, সে বড়ো শান্ত— সে চুপ করিয়া বসিয়া পুতুলগড়া দেখিতে ভালোবাসিত এবং প্রয়োজনমত রসিককে কাদা কাঠি প্রভৃতি অগ্রসর করিয়া দিত। তাহার ভারি ইচ্ছা রসিক তাহাকে একটা-কিছু ফরমাশ করে। কাজ করিতে করিতে রসিক পান চাহিবে জানিয়া সৌরভী তাহা জোগাইয়া দিবার জন্য প্রতিদিন প্রস্তুত হইয়া আসিত। রসিক স্বহস্তের কীর্তিগুলি তাহার সামনে সাজাইয়া ধরিয়া যখন বলিত, ‘সৈরি, তুই এর কোন্‌টা নিবি বল্‌’— তখন সে ইচ্ছা করিলে যেটা খুশি লইতে পারিত, কিন্তু সংকোচে কোনোটাই লইত না; রসিক নিজের পছন্দমত জিনিসটি তাহাকে তুলিয়া দিত। পুতুলগড়ার পর্ব শেষ হইলে যখন হার্মোনিয়ম বাজাইবার দিন আসিল তখন পাড়ার ছেলেমেয়েরা সকলেই এই যন্ত্রটা টেপাটুপি করিবার জন্য ঝুঁকিয়া পড়িত— রসিক তাহাদের সকলকেই হুংকার দিয়া খেদাইয়া রাখিত। সৌরভী কোনো উৎপাত করিত না— সে তাহার ডুরে শাড়ি পরিয়া বড়ো বড়ো চোখ মেলিয়া বামহাতের উপর শরীরটার ভর দিয়া হেলিয়া বসিয়া চুপ করিয়া আশ্চর্য হইয়া দেখিত। রসিক ডাকিত, ‘আয় সৈরি, একবার টিপিয়া দেখ্‌’। সে মৃদু মৃদু হাসিত, অগ্রসর হইতে চাহিত না। রসিক অসম্মতিসত্ত্বেও নিজের হাতে তাহার আঙুল ধরিয়া তাহাকে দিয়া বাজাইয়া লইত।

সৌরভীর দাদা গোপালও রসিকের ভক্তবৃন্দের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য ছিল। সৌরভীর সঙ্গে তাহার প্রভেদ এই যে, ভালো জিনিস লইবার জন্য তাহাকে কোনোদিন সাধিতে হইত না। সে আপনি ফরমাশ করিত এবং না পাইলে অস্থির করিয়া তুলিত।