বিয়াত্রিচে, দান্তে ও তাঁহার কাব্য
প্রত্যক্ষ সেই লোহিত-বসনা বিয়াত্রিচেকে দেখিতে পাইলেন–ভস্মাচ্ছন্ন পুরাতন প্রেমের বহ্নি আবার জ্বলিয়া উঠিল ও নূতন প্রেম অঙ্কুরেই শুকাইল!

‘ভিটা নুওভা’ কাব্যে বিদেশীর পথিকদিগকে সম্বোধন করিয়া নিম্নলিখিত গীতিটি লিখিত আছে-

ধীরে যাইতেছে চলি, ওগো যাত্রীদল

যেন কোন্‌ দূর বস্তু করি কল্পনা-

মাদের দহিছে যেই বিষাদ অনল

তোমাদের পরশে নি যেন সে যাতনা!

তোমাদের নিজদেশ এতই কি দূরে?

এ শোকার্ত নগরীর যাও মধ্য দিয়া

বোধ হয় তবু যেন জান না, এ পুরে

কী মহান শোকানল দহিতেছে হিয়া!

তবু যদি একবার দাঁড়াও হেথায়,

কিছুক্ষণ মোর কথা শোনো মন দিয়া-

তা হলে বিদায়কালে বিষম ব্যথায়

যাবে চলি উচ্চ স্বরে কাঁদিয়া কাঁদিয়া!

তিল মাত্র যার কথা করিলে বর্ণন,

তিল মাত্র যার কথা করিলে শ্রবণ,

মানুষ কাঁদিতে থাকে ব্যথিত অন্তর,

সেই বিয়াত্রিচে-হারা অভাগা নগর!

‘ভিটা নুওভা’ কাব্যে ইহার পরে আর-একটি মাত্র গীতি আছে। তাহাতে কবি কহিতেছেন, তাঁহার মন স্বর্গে গিয়াছিল, সেখানে দেখিলেন বিয়াত্রিচেকে দেবতারা পূজা করিতেছেন। সে বিয়াত্রিচেকে দেখিয়া কবি এমন বিস্মিত হইয়া গেলেন যে, ভাবিলেন, তাঁহাকে বর্ণনা করিতে গেলে এমন গভীর কথার প্রয়োজন হয় যে, সে কথার অর্থ তিনি নিজেই বুঝিতে পারেন না। তাহার পরেই বিয়াত্রিচে সম্বন্ধে যোগ্যতর কবিতা লিখিবেন স্থির করিয়া ‘ভিটা নুওভা’ কাব্য শেষ করিলেন।

বিয়াত্রিচে সম্বন্ধে যোগ্যতর কাব্য ‘ডিভাইনা কমিডিয়া’ (Divina Commedia)। ‘ভিটা নুওভা’ লেখা শেষ হইলে তাহার অনেক দিন পরে তাহা লিখিত হয়। এই কাব্য সম্বন্ধে কিছু বলিবার পূর্বে দান্তের কবিতার বহির্ভুক্ত জীবনের বিষয়ে দুই-এক কথা বলিয়া লই।

দান্তের প্রকৃত নাম দুরান্তে আলিঘিয়ারি (Durante Alighieri)। তাঁহার সময়ে দুই দল ছিল। গুয়েলফ ও ঘিবেলীন (Guelf and Ghibelline) শ্বেত ও কৃষ্ণ, অর্থাৎ কুলীন ও সাধারণ অধিবাসী; ইহাদের উভয় দলের মধ্যে প্রায়ই বিপ্লব চলিত, একদল ক্ষমতাশালী হইলে অপর দল নিপীড়িত হইত। দান্তে Guelf অর্থাৎ কুলীন দলভুক্ত ছিলেন। তাঁহার সময়ে গুয়েলফ দলই ক্ষমতাশালী ছিল। ‘ভিটা নুওভা’ কাব্যে দান্তের প্রেমের কাহিনী পড়িলে মনে হয় না, দান্তে বাহিরের কোনো বিষয়ে লিপ্ত ছিলেন–মনে হয় তাঁহার চক্ষে সমুদয় জগতের সমষ্টি বিয়াত্রিচে, এ সংসারে আর কিছু নাই কেবল বিয়াত্রিচে, এ সংসারে আর কিছু করিবার নাই-কেবল বিয়াত্রিচের আরাধনা! যখন তিনি বিয়াত্রিচের প্রতি-হাস্যে প্রতি-উপেক্ষায় শিশুর ন্যায় রোদন করিতেছিলেন, প্রতি ক্ষুদ্র নমস্কারে