গেটে ও তাঁহার প্রণয়িনীগণ
গ্রেশেনের উপর হইতে তাঁহার সমস্ত ভালোবাসা চলিয়া গিয়াছে। তিনি তাঁহার বন্ধুকে স্পষ্টই বলিলেন, এখন হইতে সমস্তই চুকিয়া বুকিয়া গেল। গেটে গ্রেশেনের কোনো সম্পর্কে আর রহিলেন না-তাহার নামোল্লেখ পর্যন্ত করিতেন না। এমন-কি, পূর্বে তিনি তাহার মুখশ্রী যেরূপ চক্ষে দেখিতেন, এখন তাহা বিপরীতভাবে দেখিতে লাগিলেন–এতদিনে তাহার যথার্থ ভাব বুঝিতে পারিলেন–তাহার মমতাশূন্য নীরস মুখশ্রী তাঁহার চক্ষে পরিস্ফুট হইল। কিন্তু হৃদয়ের আঘাত যন্ত্রণা শীঘ্র নিবৃত্ত হইবার নহে। তিনি কহিলেন–‘যে-সকল বন্ধুদের ব্যবহারে স্পষ্টই বোধ হয়, তোমার চরিত্র তাহারা সংশোধন করিতে চাহিতেছে তাহাদের দ্বারা কোনো ফল জন্মে না–একজন স্ত্রীলোক যাহার ব্যবহারে সহসা মনে হইতে পারে সে তোমাকে নষ্ট করিতেছে সেই স্ত্রীলোকই অলক্ষিতভাবে তোমার চরিত্র সংশোধন করে।’ তিনি তাঁহার লিখিত উপাখ্যানের এক স্থানে লিখিয়াছেন–‘কুমারীরা অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক বালকদের অপেক্ষা আপনাকে মহা বিজ্ঞ মনে করে–আর তাহাদিগকে প্রথমে যে বেচারী ভালোবাসা জানায়–তাহাদের নিকট তাহারা মহা দিদিমার চালে চলিতে থাকে।’ এ কথাটা সত্য–এবং অনেক অশ্রুজলের মধ্য হইতে তিনি এ সত্যটি উপার্জন করিয়াছিলেন। গেটের প্রেম বহুদিন অলস ও নিষ্কর্মা হইয়া বসিয়া থাকে নাই–অ্যানসেন নামক আর-একটি সুশ্রী বালিকা তাঁহার হৃদয় অধিকার করিল। গেটের এইবারকার প্রেম-কাহিনীতে আমরা প্রেমের আর-এক মূর্তি দেখিতে পাইব।

অ্যানসেন অল্পবয়স্ক, সুন্দরী, প্রফুল্ল এবং প্রিয়দর্শন ছিল। গেটে স্বীয় মোহিনী শক্তির বলে তাহার প্রেম আকর্ষণ করিয়াছিলেন, এবং সে প্রেমকে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিয়াছিলেন। কিন্তু তেমনি গেটে সে বালিকার প্রেমের উপর অত্যন্ত অন্যায় ব্যবহার করিতেন। তিনি নিজেই স্বীকার করেন–যে কারণেই হোক তাঁহার মন খারাপ হইলেই তিনি সেই বেচারীর উপরে আক্রোশ প্রকাশ করিতেন–কেন? না সে প্রাণপণে তাঁহাকে সন্তুষ্ট রাখিতে চেষ্টা করিত বলিয়া। তাঁহাকে সন্তুষ্ট রাখা তাহার ব্রত ছিল, এই সুমহৎ অপরাধে তিনি তাহার প্রতি ক্রমাগত অসন্তোষ প্রকাশ করিতেন! অনর্থক অসূয়া ও অকারণ সন্দেহে তিনি আপনাকে ও তাহাকে সর্বদাই অসুখী করিতেন। এই-সকল প্রণয়ের অত্যাচার অ্যানসেন অনেক দিন পর্যন্ত সহ্য করিয়াছিল, প্রশংসনীয় ধৈর্যের সহিত সহ্য করিয়াছিল; কিন্তু আর সহিল না। ক্রমাগত জ্বালাতন হইয়া, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঘাতের পর আঘাত পাইয়া অবশেষে তাহার ধৈর্য টুটিয়া গেল। অন্যায় অত্যাচারে তাহার প্রেম ক্রমে ক্রমে বিনষ্ট হইয়া গেল। এদিকে গেটে তাহাকে সত্য সত্য মনের সহিত ভালোবাসিতেন। অ্যানসেন যখন বিমুখ হইয়া দাঁড়াইল তখন গেটের চৈতন্য জন্মিল। এতদিন অ্যানসেন তাঁহাকে সাধিয়া আসিতেছিল, এখন তাঁহার সাধিবার পালা পড়িল। তিনি তাহার প্রেম পুনর্জীবিত করিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন; কিন্তু আর হয় না, অ্যানসেনের মন আর ফিরিবার নহে, একেবারে তাঁহার উপর হইতে তাহার প্রেম চলিয়া গিয়াছে। কিছুদিন পরে অ্যানসেনের বাসভূমি লিপ্‌সিক্‌ হইতে তাঁর জন্মভূমি ফ্র্যাঙ্কফোর্টে তিনি ফিরিয়া আসিলেন, তখন অ্যানসেনের সহিত চিঠি লেখালেখি শুরু করিলেন–লিখিলেন–‘আমাকে মনে রাখিবার জন্য অনুরোধ করিবার বোধ হয় আবশ্যক নাই। যে ব্যক্তি সার্ধ দুই বৎসর প্রায় তোমাদের পরিবার মধ্যে ভুক্ত হইয়া বাস করিয়াছিল, যে ব্যক্তি অনেক সময় তোমার অসন্তোষের কারণ হইয়াছিল সত্য কিন্তু তথাপি তোমার প্রতি সর্বদাই অনুরক্ত ছিল, সহস্র ঘটনা বোধ হয় তাহাকে তোমার স্মৃতিপথে উদিত করিয়া দিবে–অন্তত তুমি তাহার অভাব অনুভব করিবে–তুমি না কর আমি অনেক সময় করিয়া থাকি।’ দিন কতক গেটে তাহার সহিত চিঠি লেখালেখি করিয়াছিলেন–কিন্তু তাহার মন আর বিচলিত করিতে পারেন নাই। অবশেষে তাহার বিবাহবার্তা শুনিয়া কহিলেন-

‘আমি তোমার লেখা আর দেখিতে চাহি না–তোমার কণ্ঠস্বর আর শুনিতে চাহি না–আমি যে স্বপ্নে মগ্ন রহিয়াছি তাহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট। তুমি আমার আর-একটি মাত্র পত্র পাইবে, এ অঙ্গীকার আমি নিশ্চয় পালন করিব এবং এইরূপ আমার ঋণের এক অংশ মাত্র পরিশোধ দিব, অবশিষ্টটুকু আমাকে মার্জনা করিয়ো।’ আর-একটি পত্র লিখিয়াছিলেন–তাহাতে কহিয়াছিলেন, ‘আমার নিজের বিষয়ে বিশেষ কিছুই বক্তব্য নাই–আমি সবল সুস্থ শরীরে পরিশ্রম করিয়া অতি সুখশান্তিতে কাল যাপন