সমস্যা
স্ত্রীও স্বামীকে দেবতা জ্ঞান করিত। সমাজের সমস্ত সুর এক হইয়া মিলিত। এখন স্বতন্ত্র শিক্ষার প্রভাবে সমাজের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠ কতকটা একাকার হইয়া পড়িতেছে। এখন বড় ভাইকে ছোট ভাই, গুরুজনদিগকে স্নেহাস্পদেরা, এমন-কি পিতাকে পুত্র, তেমন ভাবে দেখে না, তেমন করিয়া মানে না – ইহা কেহই অস্বীকার করিতে পারেন না। এই সংক্রামক ভাব যদি সমাজের সর্ব্বত্রই আক্রমণ করিয়া থাকে তবে কি কেবল পতি-পত্নীর সম্পর্কই ইহার হাত হইতে রক্ষা পাইতে পারে? তাহাদের মধ্যেও কি সাম্যভাব প্রবেশ করে নাই, অথবা দ্রুতবেগে করিতেছে না? চারি দিকের উদাহরণে এই ভক্তির ভাব কি মন হইতে শিথিল হইয়া যায় নাই? আগেকার বউরা শাশুড়িকে যেরূপ মান্য করিত এখনকার বউরা কি তেমন মান্য করে? শাশুড়ির প্রতি যে কারণে ভক্তির লাঘব হইয়াছে সেই কারণেই কি স্বামীর প্রতিও ভক্তির লাঘব হয় নাই? তবে কিরূপে আশা করা যায় পূর্ব্বে যেরূপ অচলা নিষ্ঠার সহিত বিধবারা ব্রক্ষ্মচর্য্য পালন করিতেন, এখনও তাঁহারা সেইরূপ পারিবেন? এখন বলপূর্ব্বক সেই বাহ্য অনুষ্ঠান অবলম্বন করাইলে কি সমাজে উত্তরোত্তর গুরুতর অধর্ম্মাচরণ প্রবেশ করিয়া নিদারুণ অমঙ্গলের সৃষ্টি করিবে না?

বিধবাবিবাহের সম্বন্ধে আরও একটা কথা আছে। আমাদের সমাজে একান্নবর্ত্তী পরিবারের মূল শিথিল হইয়া আসিতেছে। গুরুজনের প্রতি অচলা ভক্তি ও আত্মমতবিসর্জ্জনই একান্নবর্ত্তী পরিবারের প্রতিষ্ঠাস্থল। এখন সাম্যনীতি সমাজে বন্যার মত আসিয়াছে, কোঠা বাড়ি হইতে কঞ্চির বেড়া পর্য্যন্ত উঁচু জিনিষ যাহা কিছু আছে সমস্তই ভাসাইয়া লইয়া যাইতেছে। তাহা ছাড়া শিক্ষাও যত বাড়িতেছে, মতভেদও তত বাড়িতেছে। দুই সহোদর ভ্রাতার জীবনযাত্রার প্রণালী ও মতে মিলে না, তবে আর বেশী দিন একত্র থাকা সম্ভবে না। একান্নবর্ত্তী পরিবার-প্রথা ভাঙ্গিয়া গেলে স্বামীর মৃত্যুর পর একাকিনী বিধবা কাহাকে আশ্রয় করিবে? বিশেষতঃ তাহার যদি ছোট ছোট দুই একটি ছেলে-মেয়ে থাকে তবে তাহাদের পড়ানো শুনানো রক্ষণাবেক্ষণ কে করিবে? আজকাল যেরূপ অবস্থা ও সমাজ যেদিকে যাইতেছে, তাহারই উপযোগী পরিবর্ত্তন ও শিক্ষা হওয়া কি উচিত নয়?

কিন্তু যতদিন একান্নবর্ত্তিত্ব একেবারে না ভাঙ্গিয়া যায় ততদিনই বা বিধবাবিবাহ সুচারুরূপে সম্পন্ন হইবে কি করিয়া? স্বামী ব্যতীত শ্বশুরালয়ের আর কাহারও সহিত যাহার তেমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল না, সে রমণী স্বামীর মৃত্যুর পরে বিবাহ করিয়া শ্বশুরালয়ের সহিত একেবারেই বিচ্ছিন্ন হইতে পারে, তাহাতে আপত্তি দেখি না। কিন্তু একান্নবর্ত্তী পরিবারে শ্বশুরালয়ে স্বামী ছাড়াও কত শত বন্ধন। অতএব স্বামীর মৃত্যুতেই শ্বশুরালয় হইতে ধর্ম্মতঃ মুক্তি লাভ করা যায় না। এতদিন যাহাদের সহিত রোগে শোকে বিপদে উৎসবে অনুষ্ঠানে সুখদুঃখের আদান প্রদান চলিয়া আসিয়াছে, যাহাদের গৌরব ও কলঙ্ক তোমার নিকট কিছুই গোপন নাই, যেখানকার শিশুরা তোমার স্নেহের উপরে নির্ভর করে, সমবয়স্কেরা তোমার মমতা ও সান্ত্বনার উপর নির্ভর করে, গুরুজনেরা তোমার সেবার উপর নির্ভর করে, সেখান হইতে তুমি কোনক্রমে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করিতে পার না। তাহা হইলে ধর্ম্ম থাকে না, পরিবারে সুখশান্তি থাকে না। সমাজের ক্ষতি হয়। বিশেষতঃ বিধবার যদি সন্তান থাকে, তাহাদিগকে এক বংশ হইতে আর এক বংশে লইয়া গেলে পরিবারে অসুখ ও অশান্তি উপস্থিত হয়, যদি না লইয়া যাওয়া হয় তবে সন্তানেরা মাতৃহীন হইয়া থাকে।

ইংরাজি-শিক্ষিত অনেকের এমন মত আছে যে, স্ত্রীলোকদিগকে অন্তঃপুরের বাহির করা উচিত হয় না, তাহাতে তাঁহাদের অন্তঃপুরসুলভ কমনীয়তা প্রভৃতি গুণ নষ্ট হইয়া যায়। এ কথার সত্যমিথ্যা গুণাগুণ লইয়া আমি বিচার করিতে বসি নাই। পূর্ব্বেই এক প্রকার বলিয়াছি, সমাজের বর্ত্তমান বিপ্লবের অবস্থায় কোন্‌ কাজটা সমাজের পক্ষে সর্ব্বতোভাবে উপযোগী, কেন্‌টা নয়, তাহা নিঃসংশয়ে বলা যায় না।

বঙ্গনারীদের মুখপদ্ম যদি দুর্ভাগা সূর্য্যের তৃষিত নেত্রপথের অন্তরাল করাই অভিপ্রেত হয় তবে বর্ত্তমান বঙ্গসমাজে তাহার কতকগুলি বাধা পড়িয়াছে, আমি তাহাই দেখিতে চাই। একটা দৃষ্টান্ত দেখিলেই আমার কথা স্পষ্ট হইবে। প্রাচীন কালে দেশ-বিদেশে যাতায়াতের তেমন সুবিধা ছিল না – ব্যয় অধিক এবং পথে বিপদও অনেক ছিল। এই জন্য তখনকার রীতি ছিল “পথে নারী