বৈষ্ণব কবির গান

কেবলমাত্র শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতামাত্রের পূজা করিবে না। তখন এই স্নেহপূর্ণ ধৈর্য্য, এই আত্মবিসর্জন, এই মধুর সৌন্দর্য্য, বিনা উপদ্রবে মনুষ্যহৃদয়ে আপন সিংহাসন প্রতিষ্ঠা করিয়া লইবে। তখন বিষ্ণুদেবের গদার কাজ ফুরাইবে, পদ্ম ফুটিয়া উঠিবে।


জ্ঞানদাসের গান

পূর্বেই বলিয়াছি, সৌন্দর্য্য পৃথিবীতে স্বর্গের বার্ত্তা আনিতেছে। যে বধির, ক্রমশ তাহার বধিরতা দূর হইতেছে। বৈষ্ণব জ্ঞানদাসের একটি গান পাইয়াছি, তাহাই ভাল করিয়া বুঝিতে গিয়া আমার এত কথা মনে পড়িল।–

       মুরলী করাও উপদেশ।

যে রন্ধ্রে যে ধ্বনি উঠে জানহ বিশেষ।

কোন্‌ রন্ধ্রে বাজে বাঁশী    অতি অনুপম।

কোন্‌ রন্ধ্রে রাধা বলে     ডাকে আমার নাম॥

কোন্‌ রন্ধ্রে বাজে বাঁশী     সুললিতধ্বনি।

কোন্‌ রন্ধ্রে কেকা শব্দে    নাচে ময়ূরিণী॥

কোন্‌ রন্ধ্রে রসালে    ফুটয়ে পারিজাত।

কোন্‌ রন্ধ্রে কদম্ব    ফুটে হে প্রাণনাথ॥

কোন্‌ রন্ধ্রে ষড় ঋতু    হয় এককালে।

কোন্‌ রন্ধ্রে নিধুবন    হয় ফুলে ফলে॥

কোন্‌ রন্ধ্রে কোকিল    পঞ্চম স্বরে গায়।

একে একে শিখাইয়া     দেহো শ্যামরায়॥

       জ্ঞানদাস কহে হাসি।

“রাধে মোর” বোল   বাজিবেক বাঁশী॥


বাঁশীর স্বর

সৌন্দর্য্য-স্বরূপের হাতে সমস্ত জগৎই একটি বাঁশী। ইহার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তিনি নিশ্বাস পূরিতেছেন ও ইহার রন্ধ্রে রন্ধ্রে নূতন নূতন সুর উঠিতেছে। মানুষের মন আর কি ঘরে থাকে? তাই সে ব্যাকুল হইয়া বাহির হইতে চায়। সৌন্দর্য্যই তাঁহার আহ্বান-গান। সৌন্দর্য্যই সেই দৈববাণী। কদম্ব ফুল তাঁহার বাঁশীর স্বর, বসন্ত ঋতু তাঁহার বাঁশীর স্বর, কোকিলের পঞ্চম তান তাঁহার বাঁশীর স্বর। সে বাঁশীর স্বর কি বলিতেছে! জ্ঞানদাস হাসিয়া বুঝাইলেন, সে কেবল বলিতেছে “ রাধে, তুমি আমার”—আর কিছুই না। আমরা শুনিতেছি, সেই অসীম সৌন্দর্য্য অব্যক্ত কণ্ঠে আমাদেরই নাম ধরিয়া ডাকিতেছেন। তিনি বলিতেছেন—”তুমি আমার, তুমি আমার কাছে আইস!” এই জন্য, আমাদের চারি দিকে যখন সৌন্দর্য্য বিকশিত হইয়া উঠে তখন আমরা যেন একজন-কাহার বিরহে কাতর হই, যেন একজন-কাহার সহিত মিলনের জন্য উৎসুক হই—সংসারে আর যাহারই প্রতি মন দিই, মনের পিপাসা যেন দূর হয় না।