প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
এইরূপ যাঁহারা তার্কিক বন্ধুদিগের সহবাসে থাকেন, তাঁহাদের ভাবের উৎসমুখে পাথর চাপান থাকে। বন্ধুত্বের দক্ষিণা বাতাস বন্ধুদিগের অনুকূল হাস্যের সূর্য্যকিরণের অভাবে তাঁহাদের হৃদয়কাননের ভাবগুলি ফুটিয়া উঠিতে পারে না। যে-সকল বিশ্বাস তাঁহাদের হৃদয়ের অতি প্রিয় সামগ্রী, পাছে সেগুলিকে লইয়া যুক্তির কাক-চিলগুলা ছেঁড়াছিঁড়ি করিতে আরম্ভ করে এই ভয়ে তাহাদিগকে হৃদয়ের অন্ধকারের মধ্যেই লুকাইয়া রাখেন; তাহারা আর সূর্য্যকিরণ পায় না; তাহারা ক্রমশঃই রুগ্ন অবস্থা প্রাপ্ত হইয়া কুসংস্কারের আকার ধারণ করে! কথায় কথায় যে-সকল মত গঠিত হইয়া উঠিল, তাহারা চারি দিকে তর্কবিতর্কের ছোরাছুরি দেখিয়া ভয়ে আত্মহত্যা করিয়া মরে। তার্কিক বন্ধুদিগের সহবাসে থাকিলে প্রাণের উদারতা সঙ্কীর্ণ হইতে থাকে। আমি কাল্পনিক লোক, আমার জগৎ লাখেরাজ জমি, আমি কাহাকেও এক পয়সা খাজনা দিই না, অথচ জগতের যেখানে ইচ্ছা বিচরণ করিতে পারি, যাহা-ইচ্ছা উপভোগ করিতে পারি। তুমি যুক্তি-মহারাজের প্রজা, যুক্তিকে যতটুকু জমির খাজনা দিবে ততটুকু জমি তোমার, যখনি খাজনা দিতে না পারিবে তখনি তোমার জমি নিলামে বিক্রয় হইয়া যাইবে। তোমার তার্কিক বন্ধু পাশে বসিয়া ক্রমাগত তোমার জমি সার্বে করিতেছেন ও তোমার সীমাবন্দী করিয়া দিতেছেন; প্রতিদিন এক বিঘা, দুই বিঘা করিয়া তোমার অধিকার কমিয়া আসিতেছে।
আমি যখন রাত্রিকালে অসংখ্য তারার দিকে চাহিয়া আমার অনন্ত জীবন কল্পনা করিতেছি, জগতের এক সীমা হইতে সীমান্তর পর্য্যন্ত আমার প্রাণের বিচরণভূমি হইয়া গিয়াছে, আমি যখন নূতন নূতন আলোকে নূতন নূতন গ্রহ মাড়াইয়া নূতন নূতন জীবকে স্বজাতি করিয়া বিস্ময়বিহ্বল পথিকের মত অনন্ত বৈচিত্র্য দেখিতে দেখিতে অনন্ত পথে যাত্রা করিয়াছি, বিচিত্র জগৎপূর্ণ অনন্ত আকাশের মধ্যে যখন আমার জীবনের আদি অন্ত হারাইয়া গিয়াছে– যখন আমি মনে করিতেছি এই কাঠা-তিনেক জমির চার দিকে পাঁচিল তুলিয়া এইখানেই ধূলির মধ্যে ধূলিমুষ্টি হইয়া থাকা আমার চরম গতি নহে, জলবায়ু আকাশ চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ নক্ষত্র বিশ্বচরাচর আমার অনন্ত জীবনের ক্রীড়াভূমি – তখন দূর কর তোমার যুক্তি, তোমার তর্ক– তোমার ন্যায়শাস্ত্র গলায় বাঁধিয়া যুক্তির শানবাঁধান ‘কুয়োর মধ্যে পরমানন্দে তুমি ডুবিয়া মর’। তখন তোমাকে কৈফিয়ত দিতে আমার ইচ্ছাও থাকে না, অবসরও থাকে না। তুমি যে আমার অতখানি কাড়িতে চাও তাহার বদলে আমাকে কি দিতে পার? তোমার আছে কি? আমি যে জায়গায় বেড়াইতেছিলাম তুমি তাহার কিছু ঠিকানা করিয়াছ? সেখানকার মেরুপ্রদেশের মহাসমুদ্রে তোমার এই বুদ্ধির ফুটো নারিকেল-মালায় চড়িয়া কখনো কি আবিষ্কার করিতে বাহির হইয়াছিলে? পৃথিবীর মাটির উপর তুমি রেল পাতিয়াছ, এই ৮০০০ মাইলের ভূগোল তুমি ভালরূপ শিখিয়াছ, অতএব যদি আমি ম্যাডাগাস্কারের জায়গায় কামস্কাট্কা কল্পনা করি, তাহা হইলে নাহয় আমাকে তোমাদের স্কুলের এক ক্লাস নামাইয়া দিও, কিন্তু যে অনন্তের মধ্যে তোমাদের ঐ রেলগাড়িটা চলে নাই, কোন কালে চলিবে বলিয়া ভরসা নাই, সেখানে আমি একটু হাওয়া খাইয়া বেড়াইতেছি, ইহাতে তোমাদের মহাভারত কি অশুদ্ধ হইল?
তোমরা ত আবশ্যকবাদী, আবশ্যকের এক ইঞ্চি এদিকে ওদিকে যাও না। তোমাদেরই আবশ্যকের দোহাই দিয়া তোমাদিগকে জিজ্ঞাসা করি, আমি যে অনন্ত-রাজ্যে বিচরণ করিতেছি, যুক্তির কারাগারে পুরিয়া আমাকে সে রাজ্য হইতে বঞ্চিত করিবার আবশ্যকটা কি? যাহাতে মানুষের সুখ, উন্নতি, উপকার হয়, তাহাই ত সকল জ্ঞানের সকল কার্য্যের উদ্দেশ্য? আমি যে অসীম সুখে মগ্ন হইতেছিলাম, আমার যে প্রাণের অধিকার বাড়িতেছিল, আমার যে প্রেম জগতে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতেছিল, ইহা সংক্ষেপ করিয়া দিয়া তোমাদের কি প্রয়োজন সাধন করিলে? মনুষ্যের কি উপকার করিলে, কি সুখ বাড়াইলে? মানুষের সুখের আশা, কল্পনার অধিকার এতটাই যদি হ্রাস হয়, তবে তোমার এই মহামূল্য যুক্তিটা কিছুক্ষণের জন্য শিকায় তোলা থাক্-না কেন?