প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
অতীত কাল ধরণীর মত আমাদের অচলপ্রতিষ্ঠ করিয়া রাখে। যখন বাহিরে রৌদ্রের খরতর তাপ, আকাশ হইতে বৃষ্টি পড়ে না, তখন শিকড়ের প্রভাবে আমরা অতীতের অন্ধকার নিম্নতন দেশ হইতে রস আকর্ষণ করিতে পারি। যখন সকল সুখ ফুরাইয়া গেছে তখন আমরা পিছন ফিরিয়া অতীতের ভগ্নাবিশিষ্ট চিহ্নসকল অনুসরণ করিয়া অতীতে যাইবার পথ অনুসন্ধান করিয়া লই। বর্ত্তমানে যখন নিতান্ত দুর্ভিক্ষ নিতান্ত উৎপীড়ন দেখি তখন অতীতের মাতৃক্রোড়ে বিশ্রাম করিতে যাই। বাঙ্গালা সাহিত্যে যে এত পুরাতত্ত্বের আলোচনা দেখা যাইতেছে তাহার প্রধান কারণ, আমাদের একমাত্র সান্ত্বনার স্থল অতীত কালকে জীবন্ত করিয়া তুলিবার চেষ্টা হইতেছে। সে পথও যদি কেহ বন্ধ করিতে চায়, অতীতের যাহা-কিছু অবশেষ আমাদের ঘরে ঘরে পড়িয়া রহিয়াছে তাহাকে দূর করিয়া যদি কেহ অতীতকে আরও অতীতে ফেলিতে চায়, তবে সে সমস্ত জাতির অভিশাপের পাত্র হইবে।
যদি আমরা অতীতকে হারাই তবে আমরা কতখানি হারাই! আমাদের কতটুকু প্রাণ থাকে! একটি নিমেষ মাত্র লইয়া কিসের সুখ! আমাদের জীবন যদি কতকগুলি বিচ্ছিন্ন জলবিম্ব মাত্র হয়, তবে তাহা অত্যন্ত দুর্বল জীবন। কিন্তু আমাদের জীবনের জন্মশিখর হইতে আরম্ভ করিয়া সাগরসঙ্গম পর্যন্ত যদি যোগ থাকে তবে তাহার কত বল! তবে তাহা পাষাণের বাধা মানিবে না, কথায় কথায় রৌদ্রতাপে শুকাইয়া বাষ্প হইয়া যাইবে না। আমি কিছু পরগাছা নহি, গাছ হইতে গাছে ঝুলিয়া বেড়াই না। বাহিরের রৌদ্র, বাহিরের বাতাস, বাহিরের বৃষ্টি আমি ভোগ করিতেছি, কিন্তু মাটির ভিতরে ভিতরে প্রসারিত আমার অতীতের উপর আমি দাঁড়াইয়া আছি। আমার অতীতের মধ্যে আমার কতকগুলি তীর্থস্থান প্রতিষ্ঠিত আছে, যখন বর্তমানে পাপে তাপে শোকে কাতর হইয়া পড়ি তখন সেই তীর্থস্থানে গমন করি, সরল বাল্যকালের সমীরণ ভোগ করি – নবজীবনের প্রথম সংকল্প, মহৎ উদ্দেশ্য, তরুণ আশাসকল পুনরায় দেখিতে পাই। আমার এ অতীতের পথ যদি মুছিয়া যাইত তাহা হইলে আজ আমি কী হইতাম! একটি জরাজীর্ণ কঠোরহৃদয় অবিশ্বাসী বিদ্রূপ-পরায়ণ বৃদ্ধ হইয়া উদাসনেত্রে সংসারের দিকে চাহিয়া থাকিতাম।
এই জন্যই আমি এই-সকল অতিশয় তুচ্ছদ্রব্যগুলিকে, অতীত কালের অতি সামান্য চিহ্নটুকুকেও যত্ন করিয়া রাখিয়াছি; অত্যধিক জ্ঞানলাভ করিয়া, কুসংস্কারের অত্যন্ত অভাবে সেগুলিকে অনাবশ্যক- বোধে ফেলিয়া দিই নাই।