নষ্টনীড়
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

সেদিন আষাঢ়ের নবীন মেঘে আকাশ আচ্ছন্ন। ঘরের মধ্যে অন্ধকার ঘনীভূত হইয়াছে বলিয়া চারু তাহার খোলা জানালার কাছে একান্ত ঝুঁকিয়া পড়িয়া কী একটা লিখিতেছে।

অমল কখন নিঃশব্দপদে পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইল তাহা সে জানিতে পারিল না। বাদলার স্নিগ্ধ আলোকে চারু লিখিয়া গেল, অমল পড়িতে লাগিল। পাশে অমলেরই দুই-একটা ছাপানো লেখা খোলা পড়িয়া আছে; চারুর কাছে সেইগুলিই রচনার একমাত্র আদর্শ।

“তবে যে বল, তুমি লিখতে পার না! ” হঠাৎ অমলের কণ্ঠ শুনিয়া চারু অত্যন্ত চমকিয়া উঠিল;

তাড়াতাড়ি খাতা লুকাইয়া ফেলিল; কহিল, “তোমার ভারি অন্যায়।”

অমল। কী অন্যায় করেছি।

চারু। নুকিয়ে নুকিয়ে দেখছিলে কেন।

অমল। প্রকাশ্যে দেখতে পাই নে বলে।

চারু তাহার লেখা ছিঁড়িয়া ফেলিবার উপক্রম করিল। অমল ফস্‌ করিয়া তাহার হাত হইতে খাতা কাড়িয়া লইল। চারু কহিল, “তুমি যদি পড় তোমার সঙ্গে জন্মের মতো আড়ি।”

অমল। যদি পড়তে বারণ কর তা হলে তোমার সঙ্গে জন্মের মত আড়ি।

চারু। আমার মাথা খাও ঠাকুরপো, পোড়ো না।

অবশেষে চারুকেই হার মানিতে হইল। কারণ, অমলকে তাহার লেখা দেখাইবার জন্য মন ছট্‌ফট্‌ করিতেছিল, অথচ দেখাইবার বেলায় যে তাহার এত লজ্জা করিবে তাহা সে ভাবে নাই। অমল যখন অনেক অনুনয় করিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল তখন লজ্জায় চারুর হাত-পা বরফের মতো হিম হইয়া গেল। কহিল, “আমি পান নিয়ে আসি গে।” বলিয়া তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে পান সাজিবার উপলক্ষ করিয়া চলিয়া গেল।

অমল পড়া সাঙ্গ করিয়া চারুকে গিয়া কহিল, “চমৎকার হয়েছে।”

চারু পানে খয়ের দিতে ভুলিয়া কহিল, “যাও, আর ঠাট্টা করতে হবে না। দাও, আমার খাতা দাও।”

অমল কহিল, “খাতা এখন দেব না, লেখাটা কপি করে নিয়ে কাগজে পাঠাব।”

চারু। হাঁ, কাগজে পাঠাবে বৈকি! সে হবে না।

চারু ভারি গোলমাল করিতে লাগিল। অমলও কিছুতে ছাড়িল না। সে যখন বারবার শপথ করিয়া কহিল, “কাগজে দিবার উপযুক্ত হইয়াছে” তখন চারু যেন নিতান্ত হতাশ হইয়া কহিল, “তোমার সঙ্গে তো পেরে ওঠবার জো নেই! যেটা ধরবে সে আর কিছুতেই ছাড়বে না! ”

অমল কহিল, “দাদাকে একবার দেখাতে হবে।”

শুনিয়া চারু পান সাজা ফেলিয়া আসন হইতে বেগে উঠিয়া পড়িল; খাতা কাড়িবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “না, তাঁকে শোনাতে পাবে না। তাঁকে যদি আমার লেখার কথা বল তা হলে আমি আর এক অক্ষর লিখব না।”

অমল। বউঠান, তুমি ভারি ভুল বুঝছ। দাদা মুখে যাই বলুন, তোমার লেখা দেখলে খুব খুশি হবেন।

চারু। তা হোক, আমার খুশিতে কাজ নেই।