শেষের কবিতা
কপাল, সেটুকুর মধ্যেও গলদ। উপসংহারে এটুকু দেখাতে দিন যে, জগতে অন্তত আপনার শোফারের চেয়ে আমি অযোগ্য নই।”

অপরিচিতের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের অজানা বিপদের আশঙ্কায় মেয়েরা সংকোচ সরাতে চায় না। কিন্তু বিপদের এক ধাক্কায় উপক্রমণিকার অনেকখানি বিস্তৃত বেড়া এক দমে গেল ভেঙে। কোন্‌ দৈব নির্জন পাহাড়ের পথে হঠাৎ মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দুজনের মনে দেখাদেখির গাঁঠ বেঁধে দিলে; সবুর করলে না। আকস্মিকের বিদ্যুৎ-আলোতে এমন করে যা চোখে পড়ল, প্রায় মাঝে মাঝে এ যে রাত্রে জেগে উঠে অন্ধকারের পটে দেখা যাবে। চৈতন্যের মাঝখানটাতে তার গভীর ছাপ পড়ে গেল, নীল আকাশের উপরে সৃষ্টির কোন্‌ এক প্রচণ্ড ধাক্কায় যেমন সূর্য-নক্ষত্রের আগুন-জ্বলা ছাপ।

মুখে কথা না বলে মেয়েটি গাড়িতে উঠে বসল। তার নির্দেশমত গাড়ি পৌঁছল যথাস্থানে। মেয়েটি গাড়ি থেকে নেমে বললে, “কাল যদি আপনার সময় থাকে একবার এখানে আসবেন, আমাদের কর্তা-মার সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দেব।”

অমিতর ইচ্ছে হল বলে, ‘আমার সময়ের অভাব নেই, এখনই আসতে পারি।’ সংকোচে বলতে পারলে না।

বাড়ি ফিরে এসে ওর নোট-বই নিয়ে লিখতে লাগল, “পথ আজ হঠাৎ এ কী পাগলামি করলে। দুজনকে দু জায়গা থেকে ছিঁড়ে এনে আজ থেকে হয়তো এক রাস্তায় চালান করে দিলে। অ্যাস্ট্রনমার ভুল বলেছে। অজানা আকাশ থেকে চাঁদ এসে পড়েছিল পৃথিবীর কক্ষপথে– লাগল তাদের মোটরে মোটরে ধাক্কা, সেই মরণের তাড়নার পর থেকে যুগে যুগে দুজনে একসঙ্গেই চলেছে; এর আলো ওর মুখে পড়ে, ওর আলো এর মুখে। চলার বাঁধন আর ছেঁড়ে না। মনের ভিতরটা বলছে, আমাদের শুরু হল যুগলচলন, আমরা চলার সূত্রে গাঁথব ক্ষণে ক্ষণে কুড়িয়ে পাওয়া উজ্জ্বল নিমেষগুলির মালা। বাঁধা মাইনের বাঁধা খোরাকিতে ভাগ্যের দ্বারে পড়ে থাকবার জো রইল না; আমাদের দেনাপাওনা সবই হবে হঠাৎ।”

বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। বারান্দায় ঘন ঘন পায়চারি করতে করতে অমিত মনে মনে বলে উঠল, ‘কোথায় আছ নিবারণ চক্রবর্তী। এইবার ভর করো আমার ’পরে বাণী দাও, বাণী দাও’ বেরোল লম্বা সরু খাতাটা, নিবারণ চক্রবর্তী বলে গেল—

      পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি
      আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।
         রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল
         পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,
      ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে

            দিগঙ্গনার নৃত্য;
      হঠাৎ-আলোর ঝলকানি লেগে
         ঝলমল করে চিত্ত।

  নাই আমাদের কনক-চাঁপার কুঞ্জ,
      বনবীথিকায় কীর্ণ বকুলপুঞ্জ।
         হঠাৎ কখন সন্ধেবেলায়
         নামহারা ফুল গন্ধ এলায়,
            প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে
         অরুণ মেঘেরে তুচ্ছ,
      উদ্ধত যত শাখার শিখরে