দুই বোন

শশাঙ্ক বলে, “আহা ছেলেমানুষ, এখানে ওর সঙ্গী নেই কেউ, একটু খেলাধূলা না পেলে বাঁচবে কেন।”

এই তো গেল নানাপ্রকার ছেলেমানুষি। ও দিকে শশাঙ্ক যখন বাড়ি-তৈরির প্ল্যান নিয়ে পড়ে, ও তার পাশে চৌকি টেনে নিয়ে এসে বলে ‘বুঝিয়ে দাও’। সহজেই বোঝে, গাণিতিক নিয়মগুলো জটিল ঠেকে না। শশাঙ্ক ভারি খুশি হয়ে উঠে ওকে প্রব্‌লেম দেয়, ও কষে নিয়ে আসে। জুট কোম্পানির স্টীমলঞ্চে শশাঙ্ক কাজ তদন্ত করতে যায়, ও ধরে বসে ‘আমিও যাব’। শুধু যায় তা নয়, মাপজোখের হিসাব নিয়ে তর্ক করে, শশাঙ্ক পুলকিত হয়ে ওঠে। ভরপুর কবিত্বের চেয়ে এর রস বেশি। এখন তাই চেম্বারের কাজ যখন বাড়িতে নিয়ে আসে তা নিয়ে ওর মনে আশঙ্কা থাকে না। লাইন টানা, আঁক কষার কাজে তার সঙ্গী জুটেছে। ঊর্মিকে পাশে নিয়ে বুঝিয়ে বুঝিয়ে কাজ এগোয়। খুব দ্রুত বেগে এগোয় না বটে, কিন্তু সময়ের দীর্ঘতাকে সার্থক মনে হয়।

এইখানটাতে শর্মিলাকে রীতিমত ধাক্কা দেয়। ঊর্মির ছেলেমানুষি সে বোঝে, তার গৃহিণীপনার ত্রুটিও সস্নেহে সহ্য করে, কিন্তু ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীবুদ্ধির দূরত্বকে স্বয়ং অনিবার্য বলে মেনে নিয়েছিল--সেখানে ঊর্মির অবাধে গতিবিধি ওর একটুও ভালো লাগে না। ওটা নিতান্তই স্পর্ধা। আপন আপন সীমা মেনে চলাকেই গীতা বলেন স্বধর্ম।

মনে মনে অত্যন্ত অধীর হয়েই একদিন ওকে জিজ্ঞাসা করলে, “আচ্ছা ঊর্মি, তোর কি ঐ-সব আঁকাজোখা, আঁক কষা, ট্রেস করা সত্যিই ভালো লাগে?”

“আমার ভারি ভালো লাগে, দিদি।”

শর্মিলা অবিশ্বাসের সুরে বললে, “হাঁঃ ভালো লাগে! ওকে খুশি করবার জন্যই দেখাস যেন ভালো লাগে।”

নাহয় তাই হল। খাওয়ানো পরানো সেবা -যত্নে শশাঙ্ককে খুশি করাটা তো শর্মিলার মনঃপূত। কিন্তু এই জাতের খুশিটা ওর নিজের খুশির জাতের সঙ্গে মেলে না।

শশাঙ্ককে বার বার ডেকে বলে, “ওকে নিয়ে সময় নষ্ট কর কেন? ওতে যে তোমার কাজের ক্ষতি হয়। ও ছেলেমানুষ, এ-সব কী বুঝবে?”

শশাঙ্ক বলে, “আমার চেয়ে কম বোঝে না।”

মনে করে এই প্রশংসায় দিদিকে বুঝি আনন্দ দেওয়াই হল। নির্বোধ!

নিজের কাজের গৌরবে শশাঙ্ক যখন আপন স্ত্রীর প্রতি মনোযোগকে খাটো করেছিল তখন শর্মিলা সেটা যে শুধু অগত্যা মেনে নিয়েছিল তা নয়, তাতে সে গর্ব বোধ করত। তাই, ইদানীং আপন সেবাপরায়ণ হৃদয়ের দাবি অনেক পরিমাণেই কমিয়ে এনেছে। ও বলত, পুরুষমানুষ রাজার জাত, দুঃসাধ্য কর্মের অধিকার ওদের নিয়তই প্রশস্ত করতে হবে। নইলে তারা মেয়েদের চেয়েও নিচু হয়ে যায়। কেননা, মেয়েরা আপন স্বাভাবিক মাধুর্যে, ভালোবাসার জন্মগত ঐশ্বর্যেই, সংসারে প্রতিদিন আপন আসনকে সহজেই সার্থক করে। কিন্তু পুরুষের নিজেকে সার্থক করতে হয় প্রত্যহ যুদ্ধের দ্বারা। সে কালে রাজারা বিনা প্রয়োজনেই রাজ্যবিস্তার করতে বেরোত। রাজ্যলোভের জন্যে নয়, নূতন করে পৌরুষের গৌরব প্রমাণের জন্যে। এই গৌরবে মেয়েরা যেন বাধা না দেয়। শর্মিলা বাধা দেয় নি, ইচ্ছা করেই শশাঙ্ককে তার লক্ষ্য-সাধনায় সম্পূর্ণ পথ ছেড়ে দিয়েছে। এক সময়ে তাকে ওর সেবাজালে জড়িয়ে ফেলেছিল, মনে দুঃখ পেলেও সেই জালকে ক্রমশ খর্ব করে এনেছে। এখনো সেবা যথেষ্ট করে, অদৃশ্যে, নেপথ্যে।

হায় রে, আজ ওর স্বামীর এ কী পরাভব দিনে দিনে প্রকাশ হয়ে পড়ছে। রোগশয্যা থেকে সব ও দেখতে পায় না, কিন্তু যথেষ্ট আভাস পায়। শশাঙ্কের মুখ দেখলেই বুঝতে পারে, সে যেন সর্বদাই কেমন আবিষ্ট হয়ে আছে। ঐ একরত্তি মেয়েটা এসে অল্প এই কদিনেই এত বড়ো সাধনার আসন থেকে ঐ কর্মকঠিন পুরুষকে বিচলিত করে দিলে। আজ স্বামীর এই অশ্রদ্ধেয়তা শর্মিলাকে রোগের বেদনার চেয়েও বেশি করে বাজছে।