ছন্দের হসন্ত হলন্ত

এখানে ‘দুই’ ‘জুঁই’ আপন আপন উকারকে দীর্ঘ করে দুই সিলেব্‌ল্‌-এর টিকিট পেয়েছে, কান তাদের সাধুতায় সন্দেহ করলে না, দ্বার ছেড়ে দিলে। উলটো দৃষ্টান্ত দেখাই।–

এই যে এল সেই আমারি স্বপ্নে দেখা রূপ,
কই দেউলে দেউটি দিলি, কই জ্বালালি ধূপ।
যায় যদি রে যাক-না ফিরে, চাই নে তারে রাখি,
সব গেলেও হায় রে তবু স্বপ্ন রবে বাকি।

এখানে ‘এই’ ‘সেই’ ‘কই’ ‘যায়’ ‘হায়’ প্রভৃতি শব্দ এক সিলেব্‌ল্‌-এর বেশি মান দাবি করলে না। বাঙালি পাঠক সেটাকে অন্যায় না মনে করে সহজ ভাবেই নিলে।

কাঁধে মই,বলে, “কই ভুঁইচাপা গাছ”।
দইভাঁড়ে ছিপ ছাড়ে, খোঁজে কইমাছ।
ঘুঁটেছাই মেখে লাউ রাঁধে ঝাউপাতা,
কী খেতাব দেবে তায় ঘুরে যায় মাথা।

এখানে ‘মই’ ‘কই’ ‘ভুঁই’ ‘দই’ ‘ছাই’ ‘লাউ’ প্রভৃতি সকলেরই সমান দৈর্ঘ্য, যেন গ্র্যানেডিয়ারের সৈন্যদল। যে-পাঠক এটা পড়ে দুঃখ পান নি সেই পাঠককেই অনুরোধ করি, তিনি পড়ে দেখুন–

দুইজনে জুঁই তুলতে যখন

গেলেম বনের ধারে,

সন্ধ্যা-আলোর মেঘের ঝালর

ঢাকল অন্ধকারে।

কুঞ্জে গোপন গন্ধ বাজায়

নিরুদ্দেশের বাঁশি,

দোঁহার নয়ন খুঁজে বেড়ায়

দোঁহার মুখের হাসি॥

এখানে যুগ্মধ্বনিগুলো এক সিলেব্‌ল্‌-এর চাকার গাড়িতে অনায়াসে ধেয়ে চলেছে। চণ্ডীদাসের গানে রাধিকা বলেছেন, “কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো”। বাঁশি-ধ্বনির এই তো ঠিক পথ, নিয়মের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করলে মরমে পৌঁছত না। কবিরাও সেই কান লক্ষ্য করে চলেন, নিয়ম যদি চৌমাথার পাহারাওয়ালার মতো সিগ্‌ন্যাল তোলে তবু তাঁদের রুখতে পারে না।

আমার দুঃখ এই, তথাচ আইনবিৎ বলছেন যে, লিপিপদ্ধতির দোষে ‘অক্ষর গুনে ছন্দরচনার অন্ধ অভ্যাস’ আমাদের পেয়ে বসেছে। আমার বক্তব্য এই যে, ছন্দরচনার অভ্যাসটাই অন্ধ অভ্যাস। অন্ধের কান খুব সজাগ, ধ্বনির সংকেতে সে চলতে পারে, কবিরও সেই দশা। তা যদি না হত তাহলেই পায়ে পায়ে কবিকে চোখে চশমা এঁটে অক্ষর গনে গনে চলতে হত।

‘বৎসর’ ‘উৎসব’ প্রভৃতি খণ্ড ৎ-ওয়ালা কথাগুলোকে আমরা ছন্দের মাপে বাড়াই কমাই, এ রকম চাতুরী সম্ভব হয় যেহেতু খণ্ড ৎ-কে কখনো আমরা চোখে দেখার সাক্ষ্যে এক অক্ষর ধরি, আবার কখনো কানে শোনার দোহাই দিয়ে তাকে আধ অক্ষর বলে চালাই– প্রবন্ধলেখক এই অপবাদ দিয়েছেন। অভিযোগকারীর বোঝা উচিত, এটা একেবারেই অসম্ভব, কেননা ছন্দের কাজ চোখ-ভোলানো নয়, কানকে খুশি করা– সেই কানের জিনিসে ইঞ্চি-গজের মাপ চলেই না। ‘বৎসর’ প্রভৃতি শব্দ গেঞ্জিজামার