ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে লিখিত

কালিম্পঙ। ২৯ এপ্রিল ১৯৩৮

বিশ্বসৃষ্টিতে রসবৈচিত্র্যের সীমা নেই, কবির মন তার সকল দিকেই স্পর্শসচেতন–কেবলমাত্র একটা প্রেরণাতেই, তা সে যত বড়োই হোক, যেন তার রাগরাগিণী নিঃশেষিত না হয়।...

ইতিমধ্যে মণ্টু বিখ্যাত গায়িকা কেসরবাইকে এনেছিল আমাকে গান শোনাবার জন্যে। আশ্চর্য তার সাধনা, কণ্ঠে মাধুর্য আছে, যেমন তেমন করে সুর খেলাতে এবং সুরে খেলাতে এবং সুরে মোচড় দিতে তার অসমান্য নৈপুণ্য।

এ’কে ভালো বলতে বাধ্য, কিন্তু ভালো লাগতে নয়। সংগীত যখন রূপঘনিষ্ঠ প্রাণবান দেহ নেয় তখন তার যত খুশি টেনে বাড়ানো, ছেঁটে কমানো, তাকে আছড়ানো, মোচড়ানো, কলাতত্ত্ববিরোধী। পুরূভুজজাতীয় আদিম জীব অবয়বহীন, ইংরেজিতে যাকে বলে amorphous, তাকে দুখানা করলেও যা সাতখানা করলেও তা। পূর্ণ অভিব্যক্ত জীবে এই অত্যাচার খাটে না। তার স্বভাবসীমাকে কিছুদূর অতিক্রম করা চলে, কিন্তু বেশি দূর নয়। এইজন্যে কেসরবাইয়ের গানকে কান তারিফ করলেও মন স্বীকার করছিল না। যারা ওস্তাদি-নেশা-গ্রস্ত তাদের এই কলাতত্ত্বের সহজ কথা বুঝিয়ে দেওয়া শক্ত। কেননা, নেশার সীমা নেই, ভোজের আছে। ‘ঢাল্‌ ঢাল্‌ সুরা আরো ঢাল্‌’ এটাকে মাৎলামি বলে হাসতে পারি, কিন্তু দই ক্ষীর সন্দেশের বেলা যথাস্থানে থামার দ্বারাই তাকে সম্মান দেওয়া হয়–না থামালেই সেটা বীভৎস হয়ে ওঠে। কেসরবাই যে জাতীয় গান গায়, শারীরিক ক্লান্তি ছাড়া তার থামবার এমন কোনোই সুবিহিত প্রেরণা নেই যা তার অন্তর্নিহিত। তাতে কেসরবাইকে অপরাধী করি নে, এইজাতীয় সংগীতকেই করি। কেসরবাইয়ের গাওয়াতে কেবল যে সাধনার পরিচয় আছে তা নয়, বিধিদত্ত ক্ষমতারও পরিচয় আছে–যা ওস্তাদের নেই। কিন্তু ততঃ কিম্‌! এই শক্তি ভুল বাহন নিয়ে ব্যর্থ হয়েছে, নন্দনবনে যে অপ্সরার যোগ্যস্থান ছিল সুন্দরবনে তার মান বাঁচানো সহজ হয় না।