বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীতশিক্ষা
কোনো হিন্দুস্থানী গানে পাওয়া যায় না। সম্ভবত তাঁর চেয়ে বড়ো ওস্তাদ তখন হিন্দুস্থানে অনেক ছিল, অর্থাৎ তাঁদের গানের সংগ্রহ আরো বেশি ছিল, তাঁদের কসরতও ছিল বহুসাধনাসাধ্য, কিন্তু যদুভট্টর মতো সংগীতভাবুক আধুনিক ভারতে আর কেউ জন্মেছে কিনা সন্দেহ। অবশ্য, এ কথাটা অস্বীকার করবার অধিকার সকলেরই আছে। কারণ, কলাবিদ্যায় যথার্থ গুণের প্রমাণ তর্কের দ্বারা স্থির হয় না, যষ্টির দ্বারাও নয়। যাই হোক, ওস্তাদ ছাঁচে ঢেলে তৈরি হতে পারে, যদুভট্ট বিধাতার স্বহস্তরচিত। অতএব চলতি কাজে যদুভট্টদের প্রত্যাশা করা বৃথা। কথাটা হচ্ছে এই যে, হিন্দুস্থানী সংগীতের মতো একটা স্থাবর পদার্থের আধার যখন খুঁজি তখন ওস্তাদকেই সহজে হাতের কাছে পাই। বিশুদ্ধ রাগরাগিণী শুনতে বা শিখতে চাই তখন ওস্তাদকেই খুঁজি। যেমন, যে পূজাবিধি মন্ত্রে ও অনুষ্ঠানে একেবারে অচল করে বাঁধা তার জন্যে পুরুতের দরকার হয়–তখন এমন লোককে জুটিয়ে আনি, অক্ষরে অক্ষরে যার সমস্ত ক্রিয়াকলাপ অভ্যস্ত। তার মানে বুঝতে পারে এতটুকু সংস্কৃতজ্ঞান এই পুরুতের পক্ষে অনাবশ্যক। কারণ, এইসকল ক্রিয়াকলাপের বাইরের রূপটাই হল প্রধান; সেটা যদি বিশুদ্ধ হয় তা হলেই কাজটা নিষ্পন্ন হতে পারে। যিনি পণ্ডিত তিনি তাঁর অর্থবোধের দ্বারা এই-সকল মন্ত্রে হয়তো প্রাণ দিতে পারেন, কিন্তু একান্ত চর্চার অভাবে বাইরের দিকে তাঁর স্খলন হতে পারে–অন্তত তাঁর পক্ষে কাজটা অনর্গলভাবে সহজ নাও হতে পারে। যেখানে দৃঢ় করে বেঁধে দেওয়া বাহ্যরূপটাই প্রধান সেখানে আয়াসসাধ্য অভ্যাসটাই বেশি কাজে লাগে, সেখানে প্রতিভা লজ্জিত হবে। আপিসের অভিজ্ঞ কেরানি তার স্বস্থানে উপরের অধ্যক্ষের চেয়ে বেশি যোগ্য, কিন্তু সেই যোগ্যতা সেই সীমার মধ্যেই পর্যাপ্ত।

হিন্দুস্থানী গানকে যেহেতু আমরা অতীতকালের নির্দিষ্ট বিধির দ্বারা বিচার করি, সেইজন্যেই তার এমন বাহন চাই যার চর্চা আছে, প্রতিভা যার পক্ষে বাহুল্য–যে আবিষ্কারক নয়, যে ব্যাখ্যাকারক–সংগীত যে জগদীশচন্দ্র বসু নয়, যে বিজ্ঞান-পাঠশালায় ডেমনেস্‌ট্রেটর। এক কথায় যে ওস্তাদ।

আমাদের যখন অল্প বয়স ছিল তখন কলকাতার ধনীদের ঘরে এইরকম ওস্তাদের সমাগম সর্বদাই দেখেছি। তাতে করে সংগীতের অলংকারশাস্ত্রবোধ অন্তত ধনীসমাজে প্রচলিত ছিল। সেই-সব বনেদী ঘরে গানের অলংকারশাস্ত্রবোধটা না থাকা লজ্জার বিষয় ছিল। ঠিক কোন্‌খানে সুর বা তালের কতটুকু স্খলন হচ্ছে সেটা তাঁরা অনেকেই জানতেন, সেই দিকে কান রেখেই তাঁরা গান শুনতেন। বাঁধা আদর্শের সঙ্গে তান মান লয় সম্পূর্ণ মিলেছে দেখলেই তাঁরা পুলকিত হয়ে উঠতেন। রাগিণীর যে-সব জায়গায় দুরূহ গ্রন্থি, সেইখানটাতে যে-সব গাইয়ে অনায়াসে সংকট পার হয়ে যেত তারাই বরমাল্য পেত।

যে কারণেই হোক, শহরে অনেক দিন থেকেই গাইয়ে-সমাগম বিরল হয়ে এসেছে। তাই হিন্দুস্থানী গানের অলংকারশাস্ত্র সম্বন্ধে জ্ঞানের চর্চা অনেক দিন থেকে শিক্ষিত-সম্প্রদায়ের মধ্যে নেই বললেই হয়। অথচ হিন্দুস্থানী সংগীতে অলংকারশাস্ত্রবোধটা প্রধান জিনিস। এই কারণেই যখন আমরা হিন্দুস্থানী সংগীতের বিশেষভাবে আলোচনা করতে চাই তখন ওস্তাদকে খুঁজি। সেও পাওয়া দুর্লভ হয়েছে।

আমাদের বাড়িতে একদা নানাপ্রয়োজনবশত এই রকম ওস্তাদের খোঁজ আমরা প্রায়ই করতুম। শেষ যাঁকে পাওয়া গিয়েছিল তিনি খ্যাতনামা রাধিকা গোস্বামী। অন্যান্য গায়কদের মধ্যে যদুভট্টর কাছেও তিনি শিক্ষা পেয়েছিলেন। যাঁদের কাছে তাঁর পরিচয় ছিল তাঁরা সকলেই জানেন রাধিকা গোস্বামীর কেবল যে গানের সংগ্রহ ও রাগরাগিণীর রূপজ্ঞান ছিল তা নয়, তিনি গানের মধ্যে বিশেষ একটি রসসঞ্চার করতে পারতেন। সেটা ছিল ওস্তাদের চেয়ে কিছু বেশি। সেটা যদি নাও থাকত তবু তাঁকে আমরা ওস্তাদ বলেই গণ্য করতুম, এবং ওস্তাদের কাছ থেকে যেটা আদায় করবার তা আমরা আদায় করতুম–আমরা আদায় করেও ছিলুম। সে-সব কথা সকলেরই জানা নেই।

তাঁর মৃত্যুর পরেও ওস্তাদের খোঁজ করবার দরকার ঘটেছিল। শান্তিনিকেতনে হিন্দুস্থানী গান শিক্ষা দেবার প্রয়োজন বোধ