শান্তিনিকেতন ৪
এই প্রেমে পাওয়ার মধ্যে তামসিকতা নেই, জড়ত্ব নেই। এই যে লাভ এ চরম লাভ বটে, কিন্তু পঞ্চত্বলাভের মতো এতে আমরা বিনষ্ট হই নে। তার কারণ, আমরা পূর্বেই একদিন আলোচনা করেছি। শক্তির পাওয়া ব্যাপারে পেলেই শক্তি নিশ্চেষ্ট হয়, কিন্তু প্রেমের পাওয়ায় পেলে প্রেম নিশ্চেষ্ট হয় না– বরঞ্চ তার চেষ্টা আরো গভীররূপে জাগ্রত হয়।

এইজন্যে এই যে প্রেমের ক্ষেত্রে ঈশ্বর আমাদের কাছে ধরা দেন– এই ধরা দেওয়ার দরুন তিনি আমাদের কাছে ছোটো হয়ে যান না–তাঁর পাওয়ার আনন্দ নিরন্তর প্রবাহিত হয়– সেই পাওয়া নিত্য নূতন থাকে।

মানুষের মধ্যেও যখন আমাদের সত্য প্রেম জাগ্রত হয়ে ওঠে তখন সেই প্রেমের বিষয়কে লাভ করেও লাভের অন্ত থাকে না– এমন স্থলে ব্রহ্মের কথা কী বলব? সেই কথায় উপনিষৎ বলেছেন–

                আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান্‌ ন বিভেতি কদাচন

    ব্রহ্মের আনন্দ ব্রহ্মের প্রেম যিনি জেনেছেন তিনি কোনোকালেই আর ভয় পান না।

অতএব মানুষের একটা এমন পাওয়া আছে যার সম্বন্ধে চিরকালের কথাটা প্রয়োগ করা যেতে পারে।

ভারতবর্ষ এই পাওয়ার দিকেই খুব করে মন দিয়েছিলেন। সেইজন্যেই ভারতবর্ষের হৃদয় মৈত্রেয়ীর মুখ দিয়ে বলেছেন–যেনাহং নামৃতা স্যাম্‌ কিমহং তেন কুর্যাম্‌? সেইজন্যে মৃত্যুর দিক থেকে অমৃতের দিকে ভারতবর্ষ আপনার আকাঙ্ক্ষা প্রেরণ করেছিলেন।

সেদিকে যারা মন দিয়েছে বাইরে থেকে দেখে তাদের বড়ো বলে তো বোধ হয় না। তাদের উপকরণ কোথায়? ঐশ্বর্য কোথায়?

শক্তির ক্ষেত্রে যারা সফল হয় তারা আপনাকে বড়ো করে সফল হয়– আর অধ্যাত্মক্ষেত্রে যারা সফল হয় তারা আপনাকে ত্যাগ করে সফল হয়। এইজন্য দীন যে, সে সেখানে ধন্য। যে অহংকার করবার কিছুই রাখে নি, সেই ধন্য– কেননা, ঈশ্বর স্বয়ং যেখানে নত হয়ে আমার কাছে এসেছেন, সেখানে যে নত হতে পারবে সেই তাঁকে পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারবে। এইজন্যেই প্রতিদিন প্রার্থনা করি, ‘নমস্তেহস্তু’–তোমাকে যেন নমস্কার করতে পারি, যেন নত হতে পারি, নিজের অভিমান কোথাও কিছু যেন না থাকে।

            জগতে তুমি রাজা অসীম প্রতাপ,

                হৃদয়ে তুমি হৃদয়নাথ হৃদয়হরণ রূপ।

            নীলাম্বর জ্যোতিখচিত চরণপ্রান্তে প্রসারিত,

                ফিরে সভয়ে নিয়মপথে অনন্তলোক।

            নিভৃত হৃদয়-মাঝে কিবা প্রসন্ন মুখচ্ছবি,

                প্রেমপরিপূর্ণ মধুরভাতি।

            ভকতহৃদয়ে তব করুণারস সতত বহে,

                দীনজনে সতত কর অভয়দান।