য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি
ভূমিমাতার আশঙ্কাকুল জাগ্রত দৃষ্টি।

জাহাজ বোম্বাই বন্দর পার হয়ে গেল।

ভাসল তরী সন্ধ্বেবেলা,          ভাবিলাম এ জলখেলা,

          মধুর বহিবে বায়ু ভেসে যাব রঙ্গে।

কিন্তু সী-সিক্‌নেসের কথা কে মনে করেছিল!

যখন সবুজ জলে ক্রমে নীল হয়ে এল এবং তরঙ্গে তরীতে মিলে আন্দোলন উপস্থিত করে দিলে তখন দেখলুম সমুদ্রের পক্ষে জলখেলা বটে কিন্তু আমার পক্ষে নয়।

ভাবলুম এই বেলা মানে মানে কুঠরির মধ্যে ঢুকে কম্বলটা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ি গে। যথাসত্বর ক্যাবিনের মধ্যে প্রবেশ করে কাঁধ থেকে কম্বলটা বিছানার উপর ফেলে দরজা বন্ধ করে দিলুম। ঘর অন্ধকার। বুঝলুম, আলো নিবিয়ে দিয়ে দাদা তাঁর বিছানায় শুয়েছেন। শারীরিক দুঃখ নিবেদন করে একটুখানি স্নেহ উদ্রেক করবার অভিপ্রায়ে জিজ্ঞাসা করলুম, “দাদা, ঘুমিয়েছেন কি?” হঠাৎ নিতান্ত বিজাতীয় মোটা গলায় কে একজন হুংকার দিয়ে উঠল, “হূজ দ্যাট!” আমি বললুম, “বাস রে! এ তো দাদা নয়!” তৎক্ষণাৎ বিনীতি অনুতপ্ত স্বরে জ্ঞাপন করলুম, “ক্ষমা করবেন, দৈবক্রমে ভুল কুঠরিতে প্রবেশ করেছি।” অপরিচিত কণ্ঠ বললে, “অল রাইট!” কম্বলটি পুনশ্চ তুলে নিয়ে কাতর শরীরে সংকুচিত চিত্তে বেরোতে গিয়ে দেখি দরজা খুঁজে পাই নে। বাক্স তোরঙ্গ লাঠি বিছানা প্রভৃতি বিচিত্র জিনিসের মধ্যে খট্‌খট্‌ শব্দে হাতড়ে বেড়াতে লাগলুম। ইঁদুর কলে পড়লে তার মানসিক ভাব কী রকম হয় এই অবসরে কতকটা বুঝতে পারা যেত, কিন্তু তার সঙ্গে সমুদ্রপীড়ার সংযোগ হওয়াতে ব্যাপারটা অপেক্ষাকৃত জটিল হয়ে পড়েছিল।

মন যতই ব্যাকুল হয়ে উঠছে শরীর ততই গলদ্‌ঘর্ম এবং কণ্ঠাগত অন্তরিন্দ্রিয়ের আক্ষেপ উত্তরোত্তর অবাধ্য হয়ে উঠেছে। অনুসন্ধানের পর যখন হঠাৎ মসৃণ চিক্কণ শ্বেতকাচ-নির্মিত দ্বারকর্ণটি হাতে ঠেকল, তখন মনে হল এমন প্রিয়স্পর্শসুখ বহুকাল অনুভব করা হয় নি। দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে নিঃসংশয়চিত্তে পরবর্তী ক্যাবিনের দ্বারে গিয়ে উপস্থিত। গিয়েই দেখি, আলো জ্বলছে; কিন্তু মেঝের উপর পরিত্যক্ত গাউন পেটিকোট প্রভৃতি স্ত্রীলোকের গাত্রাবরণ বিক্ষিপ্ত। আর অধিক কিছু দৃষ্টিপথে পড়বার পূর্বেই পলায়ন করলুম। প্রচলিত প্রবাদ অনুসারে বার বার তিন বার ভ্রম করবার অধিকার সকলেরই আছে, কিন্তু তৃতীয় বার পরীক্ষা করতে সাহস হল না। এবং সেরূপ শক্তিও ছিল না। অবিলম্বে জাহাজের ছাতে গিয়ে উপস্থিত হলুম। সেখানে বিহ্বলচিত্তে জাহাজের কাঠরার ‘পরে ঝুঁকে পড়ে শরীরমনের একান্ত উদ্বেগ কিঞ্চিৎ লাঘব করা গেল। তার পরে বহুলাঞ্ছিত অপরাধীর মতো আস্তে আস্তে কম্বলটি গুটিয়ে তার উপর নতমস্তক স্থাপন করে একটি কাঠের বেঞ্চিতে শুয়ে পড়লুম।

কী সর্বনাশ! এ কার কম্বল! এ তো আমার নয় দেখছি। যে সুখসুপ্ত বিশ্বস্ত ভদ্রলোকটির ঘরের মধ্যে রাত্রে প্রবেশ করে কয়েক মিনিট ধরে অনুসন্ধান-কার্যে ব্যাপৃত ছিলুম নিশ্চয় এ তারই। একবার ভাবলুম ফিরে গিয়ে চুপিচুপি তার কম্বল স্বস্থানে রেখে আমারটি নিয়ে আসি; কিন্তু যদি তার ঘুম ভেঙে যায়! পুনর্বার যদি তার ক্ষমা প্রার্থনা করবার প্রয়োজন হয় তবে সে কি আর আমাকে বিশ্বাস করবে! যদি বা করে, তবু কে রাত্রের মধ্যে দু-বার ক্ষমা প্রার্থনা করলে নিদ্রাকাতর বিদেশীর খ্রীষ্টীয় সহিষ্ণুতার প্রতি অতিমাত্র উপদ্রব করা হবে না কি! আরো একটা ভয়ংকর সম্ভাবনার কথা মনে উদয় হল। দৈববশত দ্বিতীয় বার যে ক্যাবিনের দ্বারে গিয়ে পড়েছিলুম তৃতীয় বারও যদি ভ্রমক্রমে সেইখানে গিয়েই উপস্থিত হই এবং প্রথম ক্যাবিনের ভদ্রলোকটির কম্বলটি সেখানে রেখে সেখানাকার একটি গাত্রাচ্ছাদন তুলে নিয়ে আসি তাহলে কী রকমের একটা রোমহর্ষণ প্রমাদ-প্রহেলিকা উপস্থিত হয়! ইত্যাকার দুশ্চিন্তায় তীব্র তাম্রকূটবাসিত পরের কম্বলের উপর কাষ্ঠাসনে রাত্রি যাপন করলুম।

২৩ আগস্ট। আমার স্বদেশীয় সঙ্গী বন্ধুটি সমস্ত রাত্রির সুখনিদ্রাবসানে প্রাতঃকালে অত্যন্ত প্রফুল্ল পরিপুষ্ট সুস্থ মুখে ডেকের