বাংলাভাষা-পরিচয় ১৮
খেটেখুটে খেয়েদেয়ে ঠেলেঠুলে : এরা ধ্বনির পুনরাবৃত্তিতে মনকে ঠেলে দেবার কাজ করে।

আর-একরকম ক্রিয়াবিশেষণ আছে ক্রিয়া পদকে দুনো করে নিয়ে। যেমন, ‘জ্বর হবে হবে’ কিংবা ‘জ্বর জ্বর করছে’। মনটা ‘পালাই পালাই’ করে। এর মধ্যে খানিকটা অনিশ্চয়তা অর্থাৎ হওয়ার কাছাকাছি ভাব আছে। ‘লড়াই লড়াই খেলা’ সত্যিকার লড়াই নয় কিন্তু যেন লড়াই। ‘হতে হতে হল না’ অর্থাৎ হতে গিয়ে হল না। এতে যেমন জোর কমায়, আবার কোনো স্থলে জোর বাড়ায় : দেখতে দেখতে জল বেড়ে গেল, হাতে হাতে ফল পাওয়া। সরে সরে যাওয়া, চলে চলে ক্লান্ত, কেঁদে কেঁদে চোখ লাল, পিছু পিছু চলা, কাছে কাছে থাকা : এই দ্বিত্বে নিরন্তরতার ভাব পাওয়া যায়, কিন্তু একটাকা নিরন্তরতা নয়, এর মধ্যে একটা বারংবারত্ব আছে। ‘পাতেপাতেই মাছের মুড়ো দেওয়া হয়েছে’ বললে মনে হয় সেটা যেন একে একে পরে পরে গণনীয়। ‘পাথরটা পড়ি পড়ি করছে’, কোনো কালেই হয়তো পড়বে না, কিন্তু প্রত্যেক মুহূর্তে বারে বারে তার ভাবখানা পড়বার মতো। ‘আপনি আপনিই তিনি বকে যাচ্ছেন’ বললে কেবল যে স্বগত বকা বোঝায় তা নয়, বোঝায় পুনঃ পুনঃ বকা। এরকম ভাবব্যঞ্জনা কোনো স্পষ্টার্থক বিশেষণের দ্বারা সম্ভব নয়। এ যেন সিনেমায় ছবি নেওয়ার প্রণালীতে পুনঃ পুনঃ অনুভূতির সমষ্টি।

ক্রিয়ার বিশেষণে অর্থহীন ধ্বনি সম্বন্ধে ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’ বইখানিতে অনেক দৃষ্টান্ত দেখিয়েছি, যেমন : ফস্‌ করে, চট্‌ করে, ধুপ্‌ করে, ধাঁ করে, সোঁ করে, ঢ্যাঁচ্ করে দেওয়া, গ্যাঁট হয়ে বসা, ঢিপ করে প্রণাম করা। এদের কোনো শব্দই সার্থক নয় অথচ অর্থবান শব্দের চেয়ে এরা স্পষ্ট করে মনে রেখাপাত করে। ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ্‌দুর, ধু ধু করছে মাঠ, থই থই করছে জল : এরা এক আঁচড়ের ছবি।

শারীরিক বেদনাগুলি ইংরেজি ভাষায় অর্থবান শব্দ দিয়ে বোঝানো হয়, যেমন : throbbing cutting gnawing pricking ইত্যাদি। এরকম দৈহিক উপলব্ধির ভিন্ন ভিন্ন শব্দ বাংলা ভাষায় নেই। বাংলার আছে ধ্বনি : দব্‌দব্‌ ঝন্‌ঝন্‌ টন্‌টন্‌ কন্‌কন্‌ কুট্‌কুট্‌ কর্‌কর্‌ তিড়িক্‌তিড়িক্‌ ঘিন্‌ঘিন্‌ ঝিম্‌ঝিম্‌ সুড়্‌সুড়্‌ সির্‌সির্‌। এই ধ্বনিগুলির সঙ্গে অনুভূতির কোনোই শব্দগত সাদৃশ্য নেই, তুব এই নিরর্থক শব্দগুলির দ্বারা অনুভূতির যেমন স্পষ্ট ধারণা হয় এমন আর কিছুতেই হতে পারে না।

বাংলা ক্রিয়াপদে আর-এক বিশেষত্ব আছে দুটো ক্রিয়ার জোড় দেওয়া, তাদের মধ্যে অর্থের সংগতি না থাকলেও, যেমন : হয়ে যাওয়া, হয়ে পড়া, হতে থাকা, হয়ে ওঠা; করে যাওয়া, করে ফেলা, করে তোলা, করে দেওয়া, করে চলা, করে ওঠা, করতে থাকা। হয়ে পড়া, করে ফেলা’র ভাবটা একই; একটা অক্রিয়, একটা সক্রিয়। আর-একরকম আছে বিশেষ্যের সঙ্গে ক্রিয়ার কিংবা দুই ক্রিয়ার অসংগত যোগ, যেমন : মার খাওয়া, উঠে পড়া, গাল দেওয়া, বসে যাওয়া, ঘুরে মরা, গিয়ে পড়া, খেয়ে বাঁচা, নেড়ে দেওয়া।