বাংলাভাষা-পরিচয় ১৬
করে সে তো কশাইয়েরই খুড়তুতো ভাই। এখানে গোরু যদিও সাধারণ বিশেষ্য তবু এখানে কর্মকারকে কে বিভক্তি দ্বারা তার সঙ্গে বিশেষ বিশেষ্যের মতো ব্যবহার করা হল। ঝিকে মেরে বৌকে শেখানো : এখানে ‘ঝি’ ‘বৌ’ বিশেষ বিশেষ্য নয়, সাধারণ বিশেষ্য, তবু কে বিভক্তি গ্রহণ করেছে। এটা বেআইনি বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আইন আছে প্রচ্ছন্ন হয়ে। রাখালসাধারণ গোরু চরিয়ে থাকে, সেই তার ব্যাবসা। কিন্তু গাড়োয়ান গোরুকে যে পীড়ন করে সে একটা বিশেষ ঘটনা, না পিটোতেও পারত। বউয়ের উপকারের জন্যে শাশুড়ি যদি ঝিকে মারে সে একটা বিশেষ ব্যাপার, মারাটা সাধারণ ঘটনা নয়। বলে থাকি ‘ময়রা মালপো তৈরি করে, ‘মালপোকে তৈরি করে’ বলিই নে। কিন্তু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলা অসম্ভব নয় যে : ময়রা মালপোকে করে তোলে জুতোর সুকতলা। মালপো তৈরি করা সাধারণ ময়রা কর্তৃক সাধারণ ব্যাপার; সুকতলার মতো মালপো তৈরি করাটা নিঃসন্দেহ সাধারণ ব্যাপার নয়।

সর্বনামের প্রসঙ্গে করণকারকের নিয়ম পূর্বেই বলা হয়েছে। অন্য বিশেষ্যপদ সম্বন্ধেও প্রায় সেই একই কথা। দ্বারা দিয়ে করে : এই তিনটে শব্দ করণকারকের প্রধান উপকরণ। সর্বনামের সঙ্গে অন্য বিশেষ্যপদের একটা প্রভেদ বিভক্তি নিয়ে; সর্বনামে কে, বিশেষ্যে এ। যথা : হাতে মারা ভালো ভাতে মারার চেয়ে, পৃথিবী পুরাবে তুমি ভরতের ধনে। সর্বনামে এই বিভক্তি বিকল্পে য়, যেমন : তোমায় দিয়ে। নিম্নের দৃষ্টান্তে কর্মকারকের চিহ্ন দেখি নে, যথা : মন দিয়ে শোনো, হাত দিয়ে খাও, লোক দিয়ে চিঠি পাঠাও। মন দিয়ে কাজ করো, বাজে কাজে হাত দিয়ো না : এখানে মনও নির্বস্তুক, হাতও তাই; এ হাত দৈহিক হাত নয়, এ হাত বলতে বোঝায় চেষ্টা। লোক দিয়ে চিঠি পাঠাও : এ লোক কোনো বিশেষ লোক নয়, সাধারণভাবে যাকে হোক কাউকে দিয়ে চিঠি পাঠাবার কথা হচ্ছে। ঘরামি দিয়ে চাল ছাইতে হবে : এখানে বিকল্পে ‘ঘরামিকে দিয়ে’ও হয়। কিন্তু ব্যক্তিবাচক বিশেষ্যে কর্মকারকে কে বিভক্তি থাকাই চাই : রামকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়ো। মানুষ ছাড়া অন্য জীববাচক বিশেষ্য সম্বন্ধেও এই নিয়ম, যেমন : বাঁদরকে দিয়ে চাষ করানো চলে না, ধোবার গাধাকে দিয়ে ঘোড়দৌড় খেলাবে না কি।

করণকারকে ‘করে শব্দ অধিকরণরূপের সঙ্গে যুক্ত হয় : গ্লাসে করে জল খাও, তুলিতে করে আঁকো।

করণকারকে ‘দিয়ে’ আর ‘করে’ শব্দে পার্থক্য আছে। ‘পাল্কিতে করে’ যাওয়া চলে, ‘পাল্কি দিয়ে’ চলে না। খাবার বেলায় বলি ‘হাতে করে খাও’; নেবার বেলায় বলি ‘হাত দিয়ে নাও’। একটাতে হাত হচ্ছে উপায়, আর-একটাতে হাত হচ্ছে আধার। পাল্কিতে ‘করে’ মানুষ যায়, কিন্তু যায় পথ ‘দিয়ে’। এখানে পাল্কি উপায়, পথ আধার। কিন্তু অর্থহিসাবে বিকল্পে হাত উপায়ও হতে পারে, আধারও হতে পারে। তাই ‘হাত দিয়ে খাও’ বলাও চলে, ‘হাতে করে খাও’ বলতেও দোষ নেই।

বলে থাকি : বড়ো রাস্তা দিয়ে যখন যাবে গাড়িতে করে যেয়ো। কোনো সাহেব যদি বলে ‘রাস্তায় করে যাবার সময় গাড়ি দিয়ে যেয়ো’, বুঝব সে বাঙালি নয়। লোক ‘দিয়ে’ পাঠাব চিঠি, লোকটা উপায়; ব্যাগে ‘করে’ সে চিঠি নেবে, ব্যাগটা আধার।