বাংলাভাষা-পরিচয় ১২
পড়ি আর। অর্থাৎ আমরা লিখি সংস্কৃত ভাষায়, ঠিক সেইটেই পড়ি প্রাকৃত বাংলা ভাষায়।

য ফলার উচ্চারণ বাংলায় কোথাও সম্মানিত হয় নি, কিন্তু এক কালে বাংলার ক্রিয়াপদে পথ হারিয়ে সে স্থান পেয়েছিল। ‘খাইল’ ‘আইল’ শব্দের ‘খাল্য’ ‘আল্য’ রূপ প্রাচীন বাংলায় দেখা গিয়েছে। ইকারটা শব্দের মাঝখান থেকে ভ্রষ্ট হয়ে শেষকালে গিয়ে পড়াতে এই ইঅ’র সৃষ্টি হয়েছিল।

বাংলার অন্য প্রদেশে এই যফলা-আকারের অভাব নেই, যেমন ‘মায়্যা মানুষ’। বাংলা সাধু ভাষার অসমাপিকা ক্রিয়াপদে যফলা-আকার ছদ্মবেশে আছে, যেমন : হইয়া খাইয়া। প্রাচীন পুঁথিতে অনেক স্থলে তার বানান দেখা যায় : হয়্যা খায়্যা।

সম্প্রতি একটা প্রশ্ন আমার কাছে এসেছে। ‘যাওয়া খাওয়া পাওয়া দেওয়া নেওয়া’ ধাতু ‘যেতে খেতে পেতে দিতে নিতে’ আকার নিয়ে থাকে, কিন্তু ‘গাওয়া বাওয়া চাওয়া কওয়া বওয়া’ কেন তেমনভাবে হয় না ‘গেতে বেতে চেতে ক’তে ব’তে’। এর যে উত্তর আমার মনে এসেছে সে হচ্ছে এই যে, যে ধাতুতে হ’এর প্রভাব আছে তার ই লোপ হয় না। ‘গাওয়া’র হিন্দি প্রতিশব্দ ‘গাহনা’, চাওয়া’র চাহনা, কওয়া’র কহনা। কিন্তু ‘খানা দেনা লেনা’র মধ্যে হ নেই। ‘বাহন’ থেকে ‘বাওয়া’, সুতরাং তার সঙ্গে হ’এর সম্বন্ধ আছে। ‘ছাদন’ ও ছাওয়া’র মধ্যপথে বোধকরি ‘ছাহন’ ছিল, তাই ‘ছাইতে’র জায়গায় ‘ছেতে’ হয় না।

স্বরবর্ণের অনুরাগ-বিরাগের সূক্ষ্ম নিয়মভেদ এবং তার স্বৈরাচার কৌতুকজনক। সংস্কৃত উচ্চারণে যে নিয়ম চলেছিল প্রাকৃতে তা চলল না, আবার নানা প্রাকৃতে নানা উচ্চারণ। বাংলা ভাষা কয়েক শো বছর আগে যা ছিল এখন তা নেই। এক ভাষা বলে চেনাই শক্ত। আগে বলত ‘পড়ই’, এখন বলে ‘পড়ে’; ‘হোহু’ হয়ে গেছে ‘হও’; ‘আমহি’ হল ‘আমি’; ‘বাম্‌হন’ হল ‘বামুন’। এই বদল হওয়ার ঝোঁক বহু লোককে আশ্রয় করে এমন স্বতোবেগে চলছে যেন এ সজীব পদার্থ। হয়তো এই মুহূর্তেই আমাদের উচ্চারণ তার কক্ষপথ থেকে অতি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। ফ হচ্ছে প, ভ হচ্ছে ব, চ হচ্ছে স, এখনো কানে স্পষ্ট ধরা পড়ছে না।

যে প্রাচীন প্রাকৃতের সঙ্গে বাংলা প্রাকৃতের নিকটসম্বন্ধ তার রঙ্গভূমিতে আমাদের স্বরবর্ণগুলি জন্মান্তরে কী রকম লীলা করে এসেছে তার অনুসরণ করে এলে অপভ্রংশের কতকগুলি বাঁধা রীতি হয়তো পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সে পথের পথিক আমি নই। খবর নিতে হলে যেতে হবে সুনীতিকুমারের দ্বারে।

কিন্তু এ সম্বন্ধে রসনার প্রকৃতিগত কোনো সাধারণ নিয়ম বের করা কঠিন হবে। কেননা দেখা যাচ্ছে, পূর্ব উত্তর বঙ্গে এবং দক্ষিণ পশ্চিম বঙ্গে অনেক স্থলে কেবল যে উচ্চারণের পার্থক্য আছে তা নয়, বৈপরীত্যও লক্ষিত হয়।

বাংলা ভাষায় স্বরবর্ণের উচ্চারণবিকার নিয়ে আরও কিছু আলোচনা করেছি আমরা বংলা শব্দতত্ত্বে।

স্বরবর্ণ সম্বন্ধে পালা শেষ করার পূর্বে একটা কথা বলে নিই। এর পরে প্রত্যয় সম্বন্ধে যেখানে বিস্তারিত করে বলেছি সেখানটা পড়লে পাঠকরা জানতে পারবেন বাংলা ভাষাটা ভঙ্গীওয়ালা ভাষা।

বাংলায় এ ও উ এই তিনটে স্বরবর্ণ কেবল যে অর্থবান শব্দের বানানের কাজে লাগে তা নয়। সেই শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কিছু ভঙ্গী তৈরি করে। ‘হরি’কে যখন ‘হরে’ বলি কিংবা ‘কালী’কে বলি ‘কেলো’, তখন সেটা সম্মানের সম্ভাষণ বলে শোনাবে না। কিন্তু ‘হরু’ বা ‘কালু’, ‘ভুলু’ বা ‘খুকু’, এমন-কি ‘খাঁদু শব্দে স্নেহ বহন করে। পূর্বে দেখানো হয়েছে বাংলা ই এবং উ স্বরটা সম্মানী, এ এবং ও অন্ত্যজ। আ স্বরটা অনাদৃত, ওর ব্যবহার আছে অনাদরে, যেমন : মাখন = মাখ্‌না, মদন = মদ্‌না, বামন = বাম্‌না। ইংরেজিতে ‘রবর্ট’ থেকে ‘বর্টি’, ‘এলিজাবেথ’ থেকে ‘লিজি’, ‘মার্গারেট’ থেকে ‘ম্যাগি’, ‘উইলিয়ম’ থেকে ‘উইলি’, ‘চার্ল্‌স’ থেকে ‘চার্লি’— ইকার স্বরে দেয় আত্মীয়তার টান। ইকারে আদর প্রকাশ বাংলাতেও পাওয়া যায়। সেখানে আকারকে ঠেলে দিয়ে ই এসে বসে, যেমন : লতা = লতি, কণা = কনি, ক্ষমা = ক্ষেমি, সরলা = সর্‌লি, মীরা = মীরি। অকারান্ত শব্দেও এ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, যেমন : স্বর্ণ = স্বর্নি। এগুলি সব মেয়ের নাম। আই যোগেও আদরের সুর লাগে, যেমন : নিমাই নিতাই কানাই