উত্তর-প্রত্যুত্তর

মধুকর ডম্বর অম্বর ভেল॥’

এই শ্লোকের শেষ ছত্রে সম্পাদক ‘যেন’ শব্দ কোথা হইতে পাইলেন এবং ‘আচ্ছন্ন’ শব্দই বা কোথা হইতে জুটিল? কোনো পদের অনুবাদ করা এক কথা, আর ব্যাখ্যা করা আর-এক কথা। অনুবাদ করিতে হইলে নিজ হইতে শব্দ দেওয়ার সকল সময়ে প্রয়োজন না হইতে পারে, কিন্তু ব্যাখ্যা করিতে হইলে অনেক সময়ে নূতন শব্দ প্রয়োগ করিতে হয়; অন্যথা সকল স্থানে ব্যাখ্যা সরল হয় না। পাঠকেরাও উত্তম রূপ বুঝিতে পারেন না। উপরে ঊদ্‌ধৃত পদটিতে একট উৎপ্রেক্ষা অলংকার আছে সুতরাং ‘যেন’ শব্দ প্রয়োগ করিয়া সম্পাদক কোনো দোষ করেন নাই। অনেক কৃতবিদ্য সুপণ্ডিত ব্যক্তি সংস্কৃত শ্লোকের ব্যাখ্যাকালে নিজ হইতে অনেক শব্দ যোগ করিয়া দিয়াছেন। উদাহরণ—

‘বশিষ্ঠ ধেনোরনুযায়িনন্তং

আবর্তমানং বনিতা বনান্তাৎ।

পপৌ নিমেষালস পক্ষ্ম পঙ্‌ক্তি

রুপোষিতাভ্যামিব লোচনাভ্যাম্‌।’

রঘুবংশ। দ্বিতীয়ঃ সর্গঃ, ১৯ শ্লোক

পণ্ডিত নবীনচন্দ্র ইহার এইরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন—‘রাজ্ঞী সুদক্ষিণা বন হইতে প্রত্যাগত বশিষ্ঠ ধেনুর অনুযায়ী রাজাকে নির্নিমেষ লোচনে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন, তাঁহার স্থির নিশ্চল দৃষ্টি দেখিয়া বোধ হইল যেন, তাঁহার লোচন যুগল বহুকাল উপোষিত থাকিয়া অতি তৃষ্ণার সহিত রাজার সৌন্দর্য পান করিতেছিল।’ এক্ষণে জিজ্ঞাসা করা যাইতে পারে ‘অতি তৃষ্ণার সহিত রাজার সৌন্দর্য পান’ কোথা হইতে আসিল? আর একজন পণ্ডিত ইহার টীকা করিয়াছেন, ‘পতি বশিষ্ঠ ধেনুর অনুচর হইয়া বন হইতে প্রত্যাগমন করিতেছেন দেখিয়া রাজ্ঞী অনিমিষ নয়নে তাঁহাকে দেখিতে লাগিলেন। বোধ হইল যেন, তাঁহার নয়ন যুগল এতক্ষণ উপবাসী ছিল এখন তদীয় সৌন্দর্য সুধা পান করিতেছে।’ ‘সৌন্দর্য সুধা’ কোথা হইতে আসিল? বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার টীকা করিতে যাইয়া দুই-একটি নিজের শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন বলিয়া আমাদের প্রবন্ধ লেখক তাঁহাকে বিদ্রূপ করিয়াছেন, কিন্তু এ-সকল টীকা পাঠ করিয়া তিনি কি বলিবেন বলিতে পারি না।

শ্রীযোগেন্দ্রনারায়ণ রায়

প্রত্যুত্তর—অর্থ ব্যাখ্যা করা এক, আর অর্থ তৈরি করা এক। অর্থ সহজ করিবার জন্য তাহাতে নূতন কথা যোগ করা কিছু মন্দ কাজ নহে, কিন্তু মূলে যে কথা নাই সেই কথা যোগ করিয়া অর্থ গড়িয়া তোলা দোষের নহে তো কী? লেখক আবার পাছে ভুল বুঝেন এই নিমিত্ত স্পষ্ট করিয়া উদাহরণ দিয়া বলিতে হইল। মনে করুন, ‘সময় বসন্ত, কান্ত রহুঁ দূরদেশ’ এই ছত্রটির অর্থ বুঝাইতে গিয়া আমি যদি বলি, ‘বসন্তের ন্যায় এমন সুখের সময়ে, প্রাণের অপেক্ষা যাহাকে ভালোবাসি, সে কান্ত দূরদেশে রহিয়াছেন’, তাহাতে দোষ পড়ে না; যদিও কথা বাড়াইলাম তথাপি কবির ভাবের অনুসরণ করিয়া চলিয়াছি। কিন্তু আমি যদি বলি ‘বসন্ত অতিক্রম করিয়া গ্রীষ্ম আসিয়া পড়িল, তথাপি আমার কান্ত দূরদেশে রহিয়াছেন’ তাহা হইলে অতিরিক্ত কথা ব্যবহারের জন্য আমি দোষী।

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রস্তাব-লেখক

উত্তর—

‘লীলা-কমলে ভ্রমরা কিয়ে বারি

চমকি চললু ধনি চকিত নেহারি।’