বাংলাভাষা-পরিচয় ১২
অপর পক্ষে বেশি খুঁজতে হয় না, যেমন : বড়ো ছোটো মেঝো সেজো ভালো কালো ধলো রাঙা সাদা ফিকে খাটো রোগা মোটা বেঁটে কুঁজো বাঁকা সিধে কানা খোঁড়া বোঁচা নুলো ন্যাকা খাঁদা ট্যারা কটা গোটা ন্যাড়া খ্যাপা মিঠে ডাঁসা কষা খাসা তোফা কাঁচা পাকা খাঁটি মেকি কড়া চোখা রোখা ভিজে হাজা শুকো গুঁড়ো বুড়ো ওঁচা খেলো ছ্যাঁদা ঝুঁটো ভীতু আগা গোড়া উঁচু নিচু কালা হাবা বোকা ঢ্যাঙা বেঁটে ঠুঁটো ঘনো।

বাংলা বর্ণমালায় ই আর উ সবচেয়ে উদ্যমশীল স্বরবর্ণ। রাসায়নিক মহলে অক্সিজেন গ্যাস নানা পদার্থের সঙ্গে নানা বিকার ঘটিয়ে দিয়ে নিজেকে রূপান্তরিত করে, ই স্বরবর্ণটা সেইরকম। অন্তত আকে বিগড়িয়ে দেবার জন্যে তার খুব উদ্যম, যেমন : থলি + আ = থলে, করি + আ = করে। ইআ প্রত্যয়ের ই পূর্ববর্তী একটা বর্ণকে ডিঙিয়ে শব্দের আদি ও অন্তে বিকার ঘটায়, তার দৃষ্টান্ত : জাল + ইআ = জেলে, বালি + ইআ = বেলে, মাটি + ইআ = মেটে, লাঠি + ইআল = লেঠেল।

পরে যখন আকার আছে ই সেখানে আ’এ হাত না দিয়ে নিজেকেই বদলে ফেলেছে, তার দৃষ্টান্ত যথা : মিঠাই = মেঠাই, বিড়াল = বেড়াল, শিয়াল = শেয়াল, কিতাব = কেতাব, খিতাব = খেতাব।

আবার নিজেকে বজায় রেখে আকারটাকে বিগড়িয়ে দিয়েছে, তার দৃষ্টান্ত দেখো : হিসাব = হিসেব, নিশান = নিশেন, বিকাল = বিকেল, বিলাত = বিলেত। ই কোনো উৎপাত করে নি এমন দৃষ্টান্তও আছে, সে বেশি নয়, অল্পই, যেমন : বিচার নিবাস কৃষাণ পিশাচ।

একদা বাংলা ক্রিয়াপদে আ স্বরবর্ণের যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল। করিলা চলিলা করিবা যাইবা : এইটেই নিয়ম ছিল। ইতিমধ্যে ই উপদ্রব বাধিয়ে দিলে। নিরীহ আকারকে সে শান্তিতে থাকতে দেয় না; ‘দিলা’কে করে তুলল ‘দিলে’, ‘করিবা’ হল ‘করবে’।

বাংলা ক্রিয়াপদের সদ্য অতীতে ইল প্রত্যয়ে বিকল্পে ও এবং এ লাগে, যেমন : করলো করলে। ‘করিল’ হয়েছে ‘করলো’, ইকারের সঙ্গে সম্বন্ধ ছিন্ন করে। ‘করিলা’ থেকে ‘করলে’ হয়েছে ইকারের শাসন মেনেই, অর্থাৎ আকে নিকটে পেয়ে ই তার যোগে একটা এ ঘটিয়েছে। মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, দক্ষিণবঙ্গের কথ্য বাংলার কথা বলছি। এই ভাষায় ‘করিলাম’ যদি ‘করলেম’ হয়ে থাকে সে তার স্বরবর্ণের প্রবৃত্তিবশত। এই কারণেই ‘হইয়া’ হয়েছে ‘হয়ে’।

বাংলায় উ স্বরবর্ণও খুব চঞ্চল। ইকার টেনে আনে এ স্বরকে, আর ও স্বরকে টানে উকার : পট + উআ = পোটো। মাঝের উ ডাইনে বাঁয়ে দিলে স্বর বদলিয়ে। শব্দের আদ্যক্ষরে যদি থাকে আ, তা হলে এই সব্যসাচী বাঁ দিকে লাগায় এ, ডান দিকে ও। ‘মাঠ’ শব্দে উআ প্রত্যয় যোগে ‘মাঠুআ’, হয়ে গেল ‘মেঠো’; ‘কাঠুআ’ থেকে ‘কেঠো’। উকারের আত্মবিসর্জনের যেমন দৃষ্টান্ত দেখলুম, তার আত্মপ্রতিষ্ঠারও দৃষ্টান্ত আছে, যেমন : কুড়াল = কুড়ুল, উনান = উনুন। কোথাও বা আদ্যক্ষরের উকার পরবর্তী আকারকে ও করে দিয়ে নিজে খাঁটি থাকে, যেমন : জুতা = জুতো, গুঁড়া = গুঁড়ো, পূজা = পুজো, সূতা = সুতো, ছুতার = ছুতোর, কুমার = কুমোর, উজাড় = উজোড়। উকারের পরবর্তী অকারকে অনেক স্থলেই উকার করে দেওয়া হয়, যেমন : পুতল = পুতুল, পুখর = পুখুর, হুকম = হুকুম, উপড় = উপুড়।

একটা কথা বলে রাখি, ইকারের সঙ্গে উকারের একটা যোগসাজোস আছে। তিন অক্ষরের কোনো শব্দের তৃতীয় বর্ণে যদি ই থাকে তা হলে সে মধ্যবর্ণের আকে তাড়িয়ে সেখানে বিনা বিচারে উ’এর আসন করে দেয়। কিন্তু প্রথমবর্ণে উ কিংবা ই থাকা চাই, যেমন : উড়ানি = উড়ুনি, নিড়ানি = নিড়ুনি, পিটানি = পিটুনি। কিন্তু ‘পেটানি’র বেলায় খাটে না; কারণ ওটা একার, ইকার নয়। ‘মাতানি’র বেলায়ও এইরূপ। ‘খাটুনি’ হয়, যেহেতু ট’এ আকারের সংস্রব নেই। গাঁথুনি মাতুনি রাঁধুনি’রও উকার এসেছে অকারকে সরিয়ে দিয়ে। সেই নিয়মে : এখুনি চিরুনি। ‘চালানি’ শব্দে আকারকে মেরে উকার দখল পেলে না, কিন্তু ‘চালনি’ শব্দে আকারকে ঠেলে ফেলে অনায়াসে হল ‘চালুনি’।