বাংলাভাষা-পরিচয় ১১
মানুষের শুধু খেয়ালের নয়, প্রয়োজনের একটা বড়ো সৃষ্টি; আধুনিক কালে যেমন সৃষ্টি তার ছাপাখানা। ছন্দ তার সংস্কৃতির ধাত্রী, ছন্দ তার স্মৃতির ভাণ্ডারী।

চলতি ভাষার স্বভাব রক্ষা করে বাংলা ছন্দে কবিতা যা লেখা হয়েছে সে আমাদের লোকগাথায়, বাউলের গানে, ছেলে ভোলাবার ও ঘুম পাড়াবার ছড়ায়, ব্রতকথায়। সাধুভাষী সাহিত্যমহলের বাইরে তাদের বস্‌তি। তারা যে সমস্তই প্রাচীন তা নয়। লক্ষণ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, তাদের অনেক আছে যারা আমাদের সমান বয়সেরই আধুনিক, এমন-কি ছন্দে মিলে ভাবে আমাদেরই শাক্‌রেদি সন্দেহ করি। একটা দৃষ্টান্ত দেখাই—

অচিন ডাকে নদীর বাঁকে

ডাক যে শোনা যায়।

অকূল পাড়ি, থামতে নারি,

সদাই ধারা ধায়।

ধারার টানে তরী চলে,

ডাকের চোটে মন যে টলে,

টানাটানি ঘুচাও জগার

হল বিষম দায়।

এর মিল, এর মাজাঘষা ছাঁদ ও শব্দবিন্যাস আধুনিক। তবুও যেটা লক্ষ্য করবার বিষয় সে হচ্ছে এর চলতি ভাষা। চলতি ভাষার কবিতা বাংলা শব্দের স্বাভাবিক হসন্তরূপ মেনে নিয়েছে। হসন্ত শব্দ স্বরবর্ণের বাধা না পাওয়াতে পরস্পর জুড়ে যায়, তাতে যুক্তবর্ণের ধ্বনি কানে লাগে। চলতি ভাষার ছন্দ সেই যুক্তবর্ণের ছন্দ। উপরের ঐ কবিতাকে সাধু ভাষার ছন্দে ঢালাই করলে তার চেহারা হয় নিম্নলিখিত মতো—

অচিনের ডাকে নদীটির বাঁকে

ডাক যেন শোনা যায়।

কূলহীন পাড়ি, থামিতে না পারি,

নিশিদিন ধারা ধায়।

সে-ধারার টানে তরীখানি চলে,

সেই ডাক শুনে মন মোর টলে,

এই টানাটানি ঘুচাও জগার

হয়েছে বিষম দায়।

যদি উচ্চারণ মেনে বানান করা যেত তা হলে বাউলের গানের চেহারা হত—

অচিণ্ডাকে নদীবাঁকে ডাক্‌যে শোনা যায়।

সাধু ভাষার কবিতায় বাংলা শব্দের হসন্তরীতি যে মানা হয় নি তা নয়, কিন্তু তাদের পরস্পরকে ঠোকাঠুকি ঘেঁষাঘেঁষি করতে দেওয়া হয় না। বাউলের গানে আছে ‘ডাকের চোটে মন যে টলে’। এখানে ‘ডাকের’ আর ‘চোটে’, ‘মন’ আর ‘যে, এদের মধ্যে উচ্চারণের কোনো ফাঁক থাকে না। কিন্তু সাধু ভাষার গানে ‘মন’ আর ‘মোর’ হসন্ত শব্দ হলেও হসন্ত শব্দের স্বভাব রক্ষা করে না, সন্ধির নিয়মে পরস্পর এঁটে যায় না।