বাংলাভাষা-পরিচয় ১০

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যিনি ঈশ্বর গুপ্তের আসরে প্রথম হাত পাকাচ্ছিলেন অত্যন্ত আড়ষ্ট বাংলা ভাষায়,সেই ভাষারই বন্ধন- মোচন করেছিলেন সেই বঙ্কিম। তিনিই তাকে দিয়েছিলেন চলবার স্বাধীনতা।

আমরা পুরাতন সাহিত্যে পেয়েছি পদ্য, সেইটেই বনেদি। কিন্তু এ কথা বলা ঠিক হবে না, সাধু ভাষার আদর্শ ছিল তার মধ্যে। ভাষাকে ছন্দে-ওজন-করা পদে বিভক্ত করতে গেলে তার মধ্যে স্বাভাবিক কথা বলার নিয়ম খাটে না, ক্রমে তার একটা বিশেষ রীতি বেঁধে যায়। প্রথমত কর্তা-কর্ম-ক্রিয়াপদের সহজ পর্যায় রক্ষা হতেই পারে না। তার পরে তার মধ্যে কতকগুলি পুরোনো শব্দ ও রীতি থেকে যায়, ছন্দের আশ্রয় পেয়ে যারা কালের বদল মানে না। চারটে লাইন পদ্য বানিয়ে তার দৃষ্টান্ত দেখানো যাক—

কার সনে নাহি জানি                  করে বসি কানাকানি,
                 সাঁঝবেলা দিগ্‌বধূ কাননে মর্মরে।
আঁচলে কুড়ায়ে তারা                  কী লাগি আপনহারা,
                  মানিকের বরমালা গাঁথে কার তরে।

এই কটা লাইনকে সাধু ভাষায় ঢালাই করতে গেলে হবে এইরকম— সন্ধ্যাকালে দিগ্বধূ অরণ্যমর্মরধ্বনিতে কাহার সহিত বিশ্রম্ভালাপে প্রবৃত্ত তাহা জানি না। জানি না কী কারণে ও কাহার জন্য আত্মবিহ্বল অবস্থায় সে আপন বস্ত্রাঞ্চলে নক্ষত্রসংগ্রহপূর্বক মাণিক্যের বরমাল্য গ্রন্থন করিতেছে।

‘সনে’ কথাটা এখন আর বলি নে, প্রাচীন পদাবলীতে ঐ অর্থে ‘সঙে’ কথা সর্বদা পাওয়া যায়। ‘নাহি জানি’ কথাটার ‘নাহি’ শব্দটা এখনকার নিয়মে ‘জানি’র সঙ্গে মিলতে পারে না। ‘নাহি’ শব্দের সংস্কৃত প্রতিশব্দ ‘নাস্তি, চলিত কথায় ‘নেই’। ‘জানি’র সঙ্গে ‘নেই’ জোড়া যায় না, বলি, ‘জানি নে’। ‘সাঁঝবেলা’ গ্রাম্যভাষায় এখনো চলে, কিন্তু যাদের জন্যে ঐ শ্লোকটা লেখা তাদের সঙ্গে আলাপে ‘সাঁঝবেলা’ শব্দটা বেখাপ। ‘বসিয়া’র জায়গায় ‘বসি’ আমরা বলি নে। যে শ্রেণীর লোকের ভাষায় ‘লেগে’ শব্দের ব্যবহার চলে তাদের খুশি করবার জন্যে দিগ্বধূ কখনো তারার মালা গাঁথেই না। ‘জন্যে’র পরিবর্তে ‘লাগি’ বা ‘লাগিয়া’ কিংবা ‘তরে’ শব্দটা ছন্দের মধ্যস্থতায় ছাড়া ভদ্রনামধারীদের রসনায় প্রবেশ পায় না। যেমতি তেমতি নেহারো উড়িলা হেরো মোরে পানে যবে হেথা সেথা নারে তারে প্রভৃতি শব্দ পদ্যের ফরমাশি।

যদি বর্ষার দিনে বন্ধু এসে কথা জুড়ে দেয় ‘হেরো ঐ পুব দিকের পানে, রহি রহি বিজুলি চমক দেয়, মোর ডর লাগে, নাহি জানি কী লাগি সাধ যায় তোমা সনে একা বসি মনের কথা করি কানাকানি’, তবে এটাকে মধুরালাপের ভূমিকা বলে কেউ মনে করবে না, বন্ধুর জন্যে উদ্‌বিগ্ন হবে।

তবু মন ভোলাবার ব্যবসায়ে পদ্য যদি সাদা ভাষার বাজে মালমশলা মেশায় তবে তাকে মাপ করা যায়, কিন্তু চলতি ব্যবহারে গদ্য যদি হঠাৎ সাধু হয়ে ওঠে তবে মহাপণ্ডিতেরাও মনে করবে, বিদ্রূপ করা হচ্ছে। কারও মাসির’পরে বিশেষ সম্মান দেখাবার জন্যে কেউ যদি বিশুদ্ধ সাধু ভাষায় বলে ‘আপনার মাতৃস্বসা আশা করি দুঃসাধ্য অতিসার ব্যাধি হইতে আরোগ্যলাভ করিয়াছেন’, তবে বোনপো ইংরেজের মুখে শুনলে মনে মনে হাসবে, বাঙালির মুখে শুনলে উচ্চহাস্য করে উঠবে।

তর্ক ওঠে, বাংলাদেশে কোন্‌ প্রদেশের ভাষাকে সাহিত্যিক কথ্যভাষা বলে মেনে নেব। উত্তর এই যে, কোনো বিশেষ কারণে বিশেষ প্রদেশের ভাষা স্বতই সর্বজনীনতার মর্যাদা পায়। যে-সকল সৌভাগ্যবান দেশে কোনো একমাত্র ভাষা বিনা তর্কে সর্বদেশের বাণীরূপে স্বীকৃত হয়েছে, সেখানেও নানা প্রাদেশিক উপভাষা আছে। বিশেষ কারণে টস্‌কানি প্রদেশের উপভাষা সমস্ত ইটালির এক ভাষা বলে গণ্য হয়েছে। তেমনি কলকাতা শহরের নিকটবর্তী চার দিকের ভাষা স্বভাবতই বাংলাদেশের সকলদেশী ভাষা বলে গণ্য হয়েছে। এই এক ভাষার সর্বজনীনতা বাংলাদেশের কল্যাণের বিষয় বলেই মনে করা উচিত। এই ভাষায় ক্রমে পূর্ববঙ্গেরও হাত