বাংলাভাষা ও বাঙালি চরিত্র : ১
গা-ঘেঁষা সংকীর্ণ এবং দরিদ্র। কাশীর সংস্কৃত উচ্চারণ শুনিলে এই প্রভেদ সহজেই উপলব্ধি হয়।

উপরের প্যারাগ্রাফে এক স্থলে commonplace শব্দ বাংলায় ব্যক্ত করিতে গিয়া ‘রোথো’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছি। কিন্তু উক্ত শব্দ ব্যবহার করিতে কেমন কুণ্ঠিত বোধ করিতেছিলাম। সকল ভাষাতেই গ্রাম্য ইতর শব্দ আছে। কিন্তু দেখিয়াছি বাংলায় বিশেষ ভাবপ্রকাশক শব্দমাত্রই গ্রাম্য। তাহাতে ভাব ছবির মতো ব্যক্ত করে বটে কিন্তু সেইসঙ্গে আরো একটা কী করে যাহা সংকোচজনক। Smile শব্দ বাংলায় ব্যক্ত করিতে হইলে হয় ‘মুচ্‌কে হাসি’ নয় ‘ঈষদ্ধাস্য’ বলিতে হইবে। কিন্তু ‘মুচ্‌কে হাসি’ সাধারণত মনের মধ্যে যে ছবি আনয়ন করে তাহা বিশুদ্ধ smile নহে, ঈষদ্ধাস্য কোনো ছবি আনয়ন করে কি না সন্দেহ। Peep শব্দকে বাংলায় ‘উঁকিমারা’ বলিতে হয়। Creep শব্দকে ‘গুঁড়িমারা’ বলিতে হয়। কিন্তু ‘উঁকিমারা’ ‘গুঁড়িমারা’ শব্দ ভাবপ্রকাশক হইলেও সর্বত্র ব্যবহারযোগ্য নহে। কারণ উক্ত শব্দগুলিতে আমাদের মনে এমন-সকল ছবি আনয়ন করে যাহার সহিত কোনো মহৎ বর্ণনার যোগসাধন করিতে পারা যায় না।

হিন্দুস্থানী বা মুসলমানদের মধ্যে একটা আদব-কায়দা আছে। একজন হিন্দুস্থানী বা মুসলমান ভৃত্য দিনের মধ্যে প্রভুর সহিত প্রথম সাক্ষাৎ হইবা মাত্রই যে সেলাম অথবা নমস্কার করে তাহার কারণ এমন নহে যে, তাহাদের মনে বাঙালি ভৃত্যের অপেক্ষা অধিক দাস্যভাব আছে, কিন্তু তাহার কারণ এই যে, সভ্যসমাজের সহস্রবিধ সম্বন্ধের ইতিকর্তব্যতা বিষয়ে তাহারা নিরলস ও সতর্ক। প্রভুর নিকটে তাহারা পরিচ্ছন্ন পরিপাটি থাকিবে, মাথায় পাগ্‌ড়ি পরিবে, বিনীত ভাব রক্ষা করিবে। স্বাভাবিক ভাবে থাকা অপেক্ষা ইহাতে অনেক আয়াস ও শিক্ষা আবশ্যক। আমরা অনেক সময়ে যাহাকে স্বাধীন ভাব মনে করি তাহা অশিক্ষিত অসভ্য ভাব। অনেক সময়ে আমাদের এই অশিক্ষিত ও বর্বর ভাব দেখিয়াই ইংরাজেরা আমাদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়, অথচ আমরা মনে মনে গর্ব করি যেন প্রভুকে যথাযোগ্য সম্মান না দেখাইয়া আমরা ভারি একটা কেল্লা ফতে করিয়া আসিলাম। এই অশিক্ষা ও অনাচারবশত আমাদের দৈনিক ভাষা ও কাজের মধ্যে একটি সুমার্জিত সুষমা একটি শ্রী লক্ষিত হয় না। আমরা কেমন যেন ‘আট-পৌরে’ ‘গায়েপড়া’ ‘ফেলাছড়া’ ‘ঢিলেঢালা’ ‘নড়বোড়ে’ রকমের জাত, পৃথিবীর কাজেও লাগি না, পৃথিবীর শোভাও সাধন করি না।

বাংলা ভাষায় কবিতা রচনা করিতে গিয়া একটি প্রধান ব্যাঘাত এই দেখিতে পাই, বাংলা ভাষায় ছবি আঁকা শব্দ অতি অল্প। কেবল উপ্‌রি-উপ্‌রি মোটামুটি একটা বর্ণনা করা যায় মাত্র, কিন্তু একটা জাজ্জ্বল্যমান মূর্তি ফুটাইয়া তুলা যায় না। লেখকের ক্ষমতার অভাব তাহার একমাত্র কারণ নহে। দৃষ্টান্ত—এক ‘চলা’ শব্দ ইংরেজিতে কম রকমে ব্যক্ত করা যায়— walk, step, move, creep, sweep, totter, waddle, এমন আরো অনেক শব্দ আছে। উহারা প্রত্যেকে বিভিন্ন ছবি রচনা করে, কেবলমাত্র ঘটনার উল্লেখ করে না। ইহা ছাড়া গঠন-বৈচিত্র্য, বর্ণ-বৈচিত্র্য সম্বন্ধে ইংরাজিতে বিচিত্র শব্দ আছে। আমরা কখনো প্রকৃতিকে স্পষ্ট করিয়া লক্ষ্য করি নাই। আমাদের চিত্রশিল্প নাই; আমাদের চিত্রে এবং কবিতায় প্রকৃতির অতি-বর্ণনাই অধিক। আমরা যেন চক্ষে কিছুই দেখি না—অলস কল্পনার মধ্যে প্রকৃতি বিকৃতাকার ধারণ করিয়া উদিত হয়। আমাদের শরীর-বর্ণনা তাহার দৃষ্টান্তস্থল। মানবদেহের এরূপ সামঞ্জস্যহীন অনৈসর্গিক বর্ণনা আর কোথাও দৃষ্ট হয় না। আমরা মোটামুটি একটা তুলনার দ্রব্য পাইলেই অমনি তাহার সাহায্যে বর্ণনা করিতে চেষ্টা করি। পরিষ্কার ছবি ব্যক্ত করিবার ঔদাসীন্য থাকাতে আমাদের ছবির ভাষা নাই। বিরহিনীর বিরহাবস্থা বর্ণনায় আমাদের অতি কল্পনা ও স্বভাবের প্রতি মনোযোগহীনতা প্রকাশ পায়। আমরা আলস্যবশত চোখে যেটুকু কম দেখি, কোণে
বসিয়া মনে মনে একটা চার্ট গড়িয়া সেটুকু পূরণ করিয়া লই। আমরা অল্পস্বল্প দেখি, অথচ খুব বিস্তৃত করিয়া generalize করি।