ভাষার খেয়াল
আচারই প্রধান; নিয়ম ক্ষীণ।—ইংরেজীতে ‘ঘামছি’ বলতে am perspiring বলে থাকি, ‘লিখছি’ বলতে am penning বলা দোষের হয় না। বাংলায় ঘামছি বললে লোকে কর্ণপাত করে কিন্তু কল্‌মাচ্চি বললে সইতে পারে না। প্রত্যয়ের দোহাই পাড়লে আচারের দোহাই পাড়বে। এই কারণেই নূতন ক্রিয়াপদ বাংলায় বানানো দুঃসাধ্য, ইংরেজিতে সহজ। ওই ভাষায় টেলিফোন কথাটার নূতন আমদানি, তবু হাতে হাতে ওটাকে ক্রিয়াপদে ফলিয়ে তুলতে কোনো মুশকিল ঘটে নি। ডানপিটে বাঙালি ছেলের মুখ দিয়েও বের হবে না ‘টেলিফোনিয়েছি’ বা ‘সাইক্লিয়েছি’। বাংলা গদ্যের অটুট শাসন কালক্রমে কিছু কিছু হয়তো বা বেড়ি আল্‌গা করে আচার ডিঙোতে দেবে। বাংলায় কাব্য-সাহিত্যই পুরাতন, এইজন্যেই প্রকাশের তাগিদে কবিতায় ভাষার পথ অনেক বেশি প্রশস্ত হয়েছে। গদ্য-সাহিত্য নূতন, এইজন্যে শব্দসৃষ্টির কাজে তার আড়ষ্টতা যায় নি। তবু ক্রমশ তার নমনীয়তা বাড়বে আশা করি। এমন-কি, আজই যদি কোনো তরুণ লেখক লেখেন, ‘মাইকেল বাংলা-সাহিত্যে নূতন সম্পদের ভাণ্ডার উদ্‌ঘাটিলেন’ তা নিয়ে প্রবীণরা খুব বেশি উত্তেজিত না হতে পারেন। ভাবীকালে আধুনিকেরা কতদূর পর্যন্ত স্পর্ধিয়ে উঠবেন বলতে পারি নে কিন্তু অন্তত এখনি তাঁরা ‘জিজ্ঞাসা করলেন’-এর জায়গায় যদি ‘জিজ্ঞাসিলেন’ চালিয়ে দেন তা হলে বাংলা ভাষা কৃতজ্ঞ হবে।

‘লজ্জা করবার কারণ নেই’ এটা আমরা লিখে থাকি। ‘লজ্জাবার কারণ নেই’ লেখাটি নির্লজ্জতা। এমন স্থলে ওই জোড়া ক্রিয়াপদটা বর্জন করাই শ্রেয় মনে করি। লিখলেই হয় ‘লজ্জার কারণ নেই’। ‘প্রুফ সংশোধন করবার বেলায়’ কথাটা সংশোধনীয়, বলা ভালো ‘সংশোধনের বেলায়’। সহজ ব’লেই গদ্যে আমরা পুরো মন দিই নে, বাহুল্য শব্দ বিনা বাধায় যেখানে সেখানে ঢুকে পড়ে। আমার রচনায় তার ব্যতিক্রম আছে এমন অহংকার আমার পক্ষে অত্যুক্তি হবে।

ভাষার খেয়াল সম্বন্ধে একটা দৃষ্টান্ত আমার প্রায় মনে পড়ে। ভালো বিশেষণ ও বাসা ক্রিয়াপদ জুড়ে ভালোবাসা শব্দটার উৎপত্তি। কিন্তু ও-দুটো শব্দ একটা অখণ্ড ক্রিয়াপদ রূপে দাঁড়িয়ে গেছে। পূর্বকালে ওই ‘বাসা’ শব্দটা হৃদয়াবেগসূচক বিশেষ্যপদকে ক্রিয়াপদে মিলিয়ে নিত। যেমন ভয় বাসা, লাজ বাসা। এখন হওয়া করা পাওয়া ক্রিয়াপদ জুড়ে ওই কাজ চালাই। ‘বাসা’ শব্দটা একমাত্র হৃদয়বোধসূচক; হওয়া পাওয়া করা তা নয়। এই কারণে ‘বাসা’ কথাটা যদি ছুটি না নিয়ে আপন পূর্ব কাজে বহাল থাকত তা হলে ভাবপ্রকাশে জোর লাগাত। ‘এ কথায় তার মন ধিক্কার বাস্‌ল’ প্রয়োগটা আমার মতে ‘ধিক্কার পেল’র চেয়ে জোরালো।