বাংলা ব্যাকরণে বিশেষ বিশেষ্য১
ইংরাজিতে এ স্থলেও ‘the room’ বলা হইয়া থাকে। কিন্তু যখন কোনো একটি বিশেষ ঘরে মধু আছে এই সংবাদটি দিবার প্রয়োজন ঘটে তখন আমরা বলি, ঘরটাতে মধু আছে। এইরূপ, যে বাক্যে একাধিক বিশেষ্যপদ আছে তাহাদের মধ্যে বক্তা যেটিকে বিশেষভাবে নির্দেশ করিতে চান সেইটির সঙ্গেই নির্দেশক যোজনা করেন। যেমন, গোরুটা মাঠে চরছে, বা মাঠটাতে গরু চরছে। জাজিমটা ঘরে পাতা, বা ঘরটাতে জাজিম পাতা। ‘আমার মন খারাপ হয় গেছে’ বা ‘আমার মনটা খারাপ হয়ে গেছে’-দুইই আমরা বলি। প্রথম বাক্যে, মন খারাপ হওয়া ব্যাপারটাই বলা হইতেছে—দ্বিতীয় বাক্যে, আমার মনই যে খারাপ হইয়া গিয়াছে তাহার উপরেই ঝোঁক।

‘টি’ সংকেতটি ছোটো আয়তনের জিনিস ও আদরের জিনিস সম্বন্ধে ‘টা’ বড়ো জিনিস সম্বন্ধে বা অবজ্ঞা কিংবা অপ্রিয়তা বুঝাইবার স্থলে বসে। যে পদার্থ সম্বন্ধে আদর বা অনাদর কিছুই বোঝায় না, তৎসম্বন্ধেও ‘টা’ প্রয়োগ হয়। ‘ছাতাটি কোথায়’ এই বাক্যে ছাতার প্রতি বক্তার একটু যত্ন প্রকাশ হয়, কিন্তু ‘ছাতাটা কোথায়’ বলিলে যত্ন বা অযত্ন কিছুই বোঝায় না।

সাধারণত নামসংজ্ঞার সহিত ‘টা’ ‘টি’ বসে না। কিন্তু বিশেষ কারণে ঝোঁক দিতে হইলে নামসংজ্ঞার সঙ্গেও নির্দেশক বসে। যেমন, হরিটা বাড়ি গেছে। সম্ভবত হরির বাড়ি যাওয়া বক্তার পক্ষে প্রীতিকর হয় নাই, টা তাহাই বুঝাইল। ‘রামটি মারা গেছে’, এখানে বিশেষভাবে করুণা প্রকাশের জন্য টি বসিল। এইরূপ শ্যামটা ভারি দুষ্ট, শৈলটি ভারি ভালো মেয়ে। এইরূপে টি ও টা অনেক স্থলে বিশেষ পদের সঙ্গে বক্তার হৃদয়ের সুর মিশাইয়া দেয়। বলা আবশ্যক মান্য ব্যক্তির নাম সম্বন্ধেও টি বা টা ব্যবহার হয় না।

সামান্যতাবাচক বা সমষ্টিবাচক বিশেষ্যপদকে বিশেষভাবে নির্দেশ করিতে হইলে নির্দেশক প্রয়োগ করা যায়। যেমন, ‘গিরিডির কয়লাটা ভালো’, ‘বেহারের মাটিটা উর্বরা’, ‘এখানে মশাটা বড়ো বেশি’, ‘ভীম নাগ সন্দেশটা করে ভালো’। কিন্তু শুদ্ধ অস্তিত্ব জ্ঞাপনের সময় এরূপ প্রয়োগ খাটে না; বলা যায় না, ‘ভীমের দোকানে সন্দেশটা আছে।’

এখানে আর একটি লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, যখন বলা যায় ‘বেহারের মাটিটা উর্বরা’ বা ‘ভীমের দোকানের সন্দেশটা ভালো’ তখন প্রশংসা সূচনা সত্ত্বেও ‘টা’ নির্দেশক ব্যবহার হয় তাহার কারণ এই যে, এই বিশেষ্যপদগুলিতে যে-সকল বস্তু বুঝাইতেছে তাহা পরিমাণে অল্প নহে।

যখন আমরা কর্তৃবাচক বিশেষ্যকে সাধারণভাবে উল্লেখ করিয়া পরিচয়বাচক বিশেষ্যকে বিশেষভাবে নির্দেশ করি, তখন শেষোক্ত বিশেষ্যের সহিত নির্দেশক যোগ হয়। যেমন, ‘হরি মানুষটা ভালো’, ‘বাঘ জন্তুটা ভীষণ’।

সাধারণত গুণবাচক বিশেষ্যে নির্দেশক যোগ হয় না—বিশেষত শুদ্ধমাত্র অস্তিত্ব জ্ঞাপনকালে তো হয়ই না। যেমন, আমরা বলি, ‘রামের সাহস আছে।’ কিন্তু ‘রামের সাহসটা কম নয়’, ‘উমার লজ্জাটা বেশি’ বলিয়া উমার বিশেষ লজ্জা ও রামের বিশেষ সাহসের উল্লেখকালে টা প্রয়োগ করি।

ইংরেজিতে ‘this’ ‘my’ প্রভৃতি সর্বনাম বিশেষণপদ থাকিলে বিশেষ্যের পূর্বে আর্টিক্‌ল্‌ বসে না কিন্তু বাংলায় তাহার বিপরীত। এরূপ স্থলে বিশেষ করিয়াই নির্দেশক বসে। যেমন, ‘এই বইটা’, আমার কলমটি’।

বিশেষণপদের সঙ্গে ‘টা’ ‘টি’ যুক্ত হয় না। যদি যুক্ত হয় তবে তাহা বিশেষ্য হইয়া যায়। যেমন, ‘অনেকটা নষ্ট হয়েছে’, ‘অর্ধেকটা রাখো’, ‘একটা দাও’, ‘আমারটা লও’, ‘তোমরা কেবল মন্দটাই দেখো’ ইত্যাদি।

নির্দেশক-চিহ্ন-যুক্ত বিশেষ্যপদে কারকের চিহ্নগুলি নির্দেশকের সহিত যুক্ত হয়। যেমন, ‘মেয়েটির’, ‘লোকটাকে’, ‘বাড়িটাতে’ ইত্যাদি।

অচেতন পদার্থবাচক বিশেষ্যপদে কর্মকারকে ‘কে’ বিভক্তিচিহ্ন প্রায় বসে না। কিন্তু ‘টি’ ‘টা’-র সহযোগে বসিতে পারে। যেমন, ‘লোহাটাকে’, ‘টেবিলটিকে’ ইত্যাদি।

ক্রোশটাক্‌ সেরটাক্‌ প্রভৃতি দূরত্ব ও পরিমাণ-বাচক শব্দের ‘টাক্‌’ প্রত্যয়টি টা ও এক শব্দের সন্ধিজাত। কিন্তু এই ‘টাক্‌’