চীনেম্যানের চিঠি
পলিটিক্‌সে, আমাদের প্রাণ অন্যত্র। সেই প্রাণ রক্ষা করিবার জন্য এশিয়া উত্তরোত্তর ব্যগ্র হইয়া উঠিতেছে। এইখানে আমরা একাকী নহি; সমস্ত এশিয়ার সহিত আমাদের যোগ রহিয়াছে। চীনেম্যানের চিঠিগুলি তাহাই প্রমাণ করিতেছে।

লেখক তাঁহার প্রথম পত্রে লিখিতেছেন–

‘আমাদের সভ্যতা জগতের মধ্যে সব চেয়ে প্রাচীন। অবশ্য, ইহা হইতে প্রমাণ হয় না যে, তাহা সব চেয়ে ভালো; তেমনি আবার ইহাও প্রমাণ হয় না যে, তাহা সব চেয়ে মন্দ। এই প্রাচীনত্বের খাতিরে অন্তত এটুকুও স্বীকার করিতে হইবে যে, আমাদের আচার অনুষ্ঠান আমাদিগকে যে একটা স্থায়িত্বের আশ্বাস দিয়াছে য়ুরোপের কোনো জাতির মধ্যে তাহা খুঁজিয়া পাওয়া ভার। আমাদের সভ্যতা কেবল যে ধ্রুব তাহা নহে, ইহার মধ্যে একটা ধর্মনীতির শৃঙ্খলা আছে; কিন্তু তোমাদের মধ্যে কেবল একটা অর্থনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা দেখিতে পাই। তোমাদের ধর্ম আমাদের ধর্মের চেয়ে ভালো কি না, এ জায়গায় আমি সে তর্ক তুলিতে চাই না–কিন্তু এটা নিশ্চয়, তোমাদের সমাজের উপর তোমাদের ধর্মের কোনো প্রভাব নাই। তোমরা খ্রীস্টানধর্ম স্বীকার কর, কিন্তু তোমাদের সভ্যতা কোনোকালেই খ্রীস্টান হয় নাই। অপর পক্ষে আমাদের সভ্যতা একেবারে অন্তরে অন্তরে কন্‌ফ্যুশিয়ান। কন্‌ফ্যুশিয়ান বলাও যা আর ধর্মনৈতিক বলাও তা। অর্থাৎ, ধর্মবন্ধনগুলিকেই ইহা প্রধানভাবে গণ্য করে। অপরপক্ষে অর্থনৈতিক বন্ধনকেই তোমরা প্রথম স্থান দাও, তাহার পরে যতটা পারো তাহার সঙ্গে ধর্মনীতি বাহির হইতে জুড়িয়া দিতে চেষ্টা কর।

‘তোমাদের পরিবার এবং আমাদের পরিবারের তুলনা করিলেই আমার কথাটা স্পষ্ট হইবে। সন্তান যতদিন পর্যন্ত না বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া নিজের ভার লইতে পারে, তোমাদের পরিবার ততদিন পর্যন্ত তাহাকে আহার দিবার ও রক্ষা করিবার একটা উপায়স্বরূপ মাত্র। যত সকাল-সকাল পারো ছেলেগুলিকে পাব্লিক স্কুলে পাঠাইয়া দাও, সেখানে তাহারা যত শীঘ্র পারে গৃহের প্রভাব হইতে নিজেদের মুক্তিদান করিয়া বসে। যেমনি তাহারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয় অমনি তাহাদিগকে রোজগার করিতে ছাড়িয়া দাও–এবং তাহার পরে অধিকাংশ স্থলেই বাপ-মার প্রতি নির্ভর যখনই ফুরাইল, বাপ-মার প্রতি কর্তব্যস্বীকারও অমনি শেষ হইল। তাহার পরে ছেলেরা যেখানে খুশি যাক,যাহা খুশি করুক, যত খুশি পাক এবং যেমন খুশি ছড়াক, তাহাতে কাহারো কথা কহিবার নাই-পরিবারবন্ধন রক্ষা করিবে কি না-করিবে তাহা সম্পূর্ণ তাহাদের ইচ্ছা। তোমাদের সমাজে এক-একটি ব্যক্তি একজন এবং সেই একজনেরা ছাড়া ছাড়া; কেহ কাহারো সহিত বদ্ধ নহে, তেমনি কোথাও কাহারো শিকড় নাই। তোমাদের সমাজকে তোমরা গতিশীল বলিয়া থাক–সর্বদাই তোমরা চলিতেছ। প্রত্যেকেই নিজের জন্য একটা নূতন রাস্তা বাহির করা কর্তব্য জ্ঞান করে। যে অবস্থার মধ্যে জন্মিয়াছ সেই অবস্থার মধ্যে স্থির থাকাকে তোমরা অগৌরব মনে কর। পুরুষ যদি পুরুষ হইতে চায় তবে সে সাহস করিবে,চেষ্টা করিবে, লড়াই করিবে এবং জয়ী হইবে। এই ভাব হইতেই তোমাদের সমাজে অপরিসীম উদ্যমের সৃষ্টি হইয়াছে, এবং বস্তুগত শিল্পাদির তোমরা উন্নতি করিতে পারিয়াছ। কিন্তু ইহা হইতেই তোমাদের সমাজে এত অস্থিরতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, এবং এইজন্যই আমাদের মতে ইহার মধ্যে ধর্মভাবের এই অভাব। চীনেম্যানের চোখে এইটেই বিশেষ করিয়া ঠেকে। তোমাদের মধ্যে কেহই সন্তুষ্ট নও–জীবনযাত্রার আয়োজনবৃদ্ধি করিতে সকলেই এত ব্যগ্র যে, কাহারো জীবনযাত্রার অবকাশ জোটে না। মানুষের মধ্যে অর্থের সম্বন্ধকেই তোমরা স্বীকার কর।’

‘পূর্বদেশীয় আমাদের কাছে ইহা বর্বরসমাজের লক্ষণ বলিয়া বোধ হয়। জীবন-যাত্রার উপকরণবৃদ্ধির মাপে আমরা সভ্যতাকে মাপি না; কিন্তু সেই জীবনযাত্রার প্রকৃতি ও মূল্য-দ্বারাই আমরা সভ্যতার বিচার করি। যেখানে কোনো সহৃদয় ও ধ্রূব বন্ধন নাই, পুরাতনের প্রতি ভক্তি নাই, বর্তমানের প্রতিও যথার্থ শ্রদ্ধা নাই, কেবল ভবিষ্যৎকেই লুব্ধভাবে লুন্ঠন করিবার চেষ্টা আছে, সেখানে আমাদের মতে যথার্থ সমাজই নাই। যদি তোমাদের আচার-অনুষ্ঠানের নকল না করিলে ধনে বিজ্ঞানে ও শিল্পে তোমাদের সঙ্গে টক্কর দেওয়া না যায়, তবে আমরা টক্কর না দেওয়াই ভালো মনে করি।’