সংগীত
তুলিয়া ফেলিলেন না। আমাদের ওস্তাদের সঙ্গে প্রভেদ এই যে ইঁহার কণ্ঠস্বরে কোথাও যেন কোনো বাধা নাই; শরীরের মুদ্রায় বা গলার সুরে কোনো কষ্টকর প্রয়াসের লক্ষণ দেখা গেল না। গানের মূর্তি একেবারে অক্ষুণ্ন অক্লান্ত হইয়া দেখা দিতে লাগিল।

এ দেশে এই যাঁহারা ভারতবর্ষীয় সংগীতের আলোচনায় প্রবৃত্ত আছেন, ইঁহারা যে কেবলমাত্র কৌতূহল চরিতার্থ করিতেছেন তাহা নহে; ইঁহারা ইহার মধ্যে একটা অপূর্ব সৌন্দর্য দেখিতে পাইয়াছেন-সেই রসটিকে গ্রহণ করিবার জন্য, এমন-কি, সম্ভবমতো আপনাদের সংগীতের অঙ্গীভূত করিয়া লইবার জন্য ইঁহারা উৎসুক হইয়াছেন। ইঁহাদের সংখ্যা এখনো নিতান্তই অল্প সন্দেহ নাই, কিন্তু আগুন একটা কোণেও যদি লাগে তবে আপনার তেজে চারি দিকে ছড়াইয়া পড়ে।

এখানকার লণ্ডন একাডেমি অফ ম্যুজিকের অধ্যক্ষ ডাক্তার ইয়র্ক্‌ট্রটারের সঙ্গে আমার দেখা হইয়াছে। তিনি ভারতবর্ষীয় সংগীতের কিছু কিছু পরিচয় পাইয়াছেন। যাহাতে লণ্ডনে এই সংগীত আলোচনার একটা উপায় ঘটে সেজন্য আমার নিকট তিনি বারম্বার ঔৎসুক্য প্রকাশ করিয়াছেন। যদি কোনো ভারতবর্ষীয় ধনী রাজা কোনো বড়ো ওস্তাদ বীণাবাদককে এখানে কিছুকাল রাখিতে পারেন তাহা হইলে, তাঁহার মতে, বিস্তর উপকার হইতে পারে।

উপকার আমাদেরই সবচেয়ে বেশি। কেননা, আমাদের শিল্পসংগীতের প্রতি শ্রদ্ধা আমরা হারাইয়াছি। আমাদের জীবনের সঙ্গে তাহার যোগ নিতান্তই ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে। নদীতে যখন ভাঁটা পড়ে তখন কেবল পাঁক বাহির হইয়া পড়িতে থাকে; আমাদের সংগীতের স্রোতস্বিনীতে জোয়ার উর্ত্তীণ হইয়া গিয়াছে বলিয়া, আমরা আজকাল তাহার তলদেশের পঙ্কিলতার মধ্যে লুটাইতেছি। তাহাতে স্নানের উল্‌টা কাজ হয়। আমাদের ঘরে ঘরে গ্রামোফোনে যে-সকল সুর বাজিতেছে, থিয়েটার হইতে যে-সকল গান শিখিতেছি, তাহা শুনিলেই বুঝিতে পারিব, আমাদের চিত্তের দারিদ্র্যে কদর্যতা যে কেবল প্রকাশমান হইয়া পড়িয়াছে তাহা নহে, সেই কদর্যতাকেই আমরা অঙ্গের ভূষণ বলিয়া ধারণ করিতেছি। সস্তা খেলো জিনিসকে কেহ একেবারে পৃথিবী হইতে বিদায় করিতে পারে না; একদল লোক সকল সমাজেই আছে, তাহাদের সংগতি তাহার ঊর্ধ্বে উঠিতে পারে না—কিন্তু, যখন সেই-সকল লোকেই দেশ ছাইয়া ফেলে তখনি সরস্বতী সস্তা দামের কলের পুতুল হইয়া পড়েন। তখনি আমাদের সাধনা হীনবল হয় এবং সিদ্ধিও তদনুরূপ হইয়া থাকে। সুতরাং এখন গ্রামোফোন ও কন্সর্ট্ত‌পার্টির আগাছায় দেশ দেখিতে দেখিতে ছাইয়া যাইবে; যে সোনার ফসলের চাষ দরকার সে ফসল মারা যাইতেছে।

একদিন আমাকে ডাক্তার কুমারস্বামী বলিয়াছিলেন, ‘হয়তো এমন সময় আসিবে যখন তোমাদের সংগীতের পরিচয় লইতে তোমাদিগকে য়ুরোপে যাইতে হইবে।’ আমাদের দেশের অনেক জিনিসকেই য়ুরোপের হাত হইতে পাইবার জন্য আমরা হাত পাতিয়া বসিয়াছি। আমাদের সংগীতকেও একবার সমুদ্রপার করিয়া তাহার পরে যখন তাহাকে ফিরিয়া পাইব তখনি হয়তো ভালো করিয়া পাইব। আমরা বহুকাল ঘরের কোণে কাটাইয়াছি, এইজন্য কোনো জিনিসের বাজার-দর জানি না; নিজের জিনিসকে যাচাই করিয়া লইব, কোন্‌খানে আমাদের গৌরব তাহা নিশ্চিত করিয়া বুঝিব, সে শক্তি আমাদের নাই।

যেখানে মানুষের সকল চেষ্টাই প্রচুর প্রাণশক্তি হইতে নিয়ত নানা আকারে উৎসারিত হইতেছে, যেখানে মানুষের সমস্ত সম্পদ জীবনের বৃহৎ কারবারে খাটিতেছে এবং মুনফায় বাড়িয়া চলিয়াছে,সেইখানে আপনাদের সামগ্রীকে না আনিলে, সেই চল্‌তি কারবারের সঙ্গে যোগ দিতে না পারিলে, আমরা আপনার পরিচয় পুরা পাইতে পারিব না; সুতরাং আমাদের অনেক শক্তি কেবল নষ্ট হইতে থাকিবে। পাছে য়ুরোপের সংসর্গে আমরা আপনাকে বিস্মৃত হই, এই ভয়ের কথাই আমরা শুনিয়া আসিতেছি; কিন্তু তাহা সত্য নহে, তাহার উল্টা কথাই সত্য। এই প্রবল সজীব শক্তির প্রথম সংঘাতে কিছুকালের জন্য আমরা দিশা হারাইয়া থাকি, কিন্তু শেষকালে আমরা নিজের প্রকৃতিকেই জাগ্রততর করিয়া পাই। য়ুরোপের প্রাণবান সাহিত্য আমাদের সাহিত্যের প্রয়াসকে জাগাইয়াছে; তাহা যতই বলবান হইয়া উঠিতেছে ততই অনুকরণের হাত এড়াইয়া আমাদিগকে আত্মপ্রকাশের পথে অগ্রসর করিয়া দিতেছে। আমাদের