দেশীয় রাজ্য
যখন গ্রীসের সংস্রবে আসিল তখন বাহুবলে ও কর্মবিধিতে জয়ী হইয়াও বিদ্যাবুদ্ধিতে গ্রীসের কাছে হার মানিল, গ্রীসের কলাবিদ্যা ও সাহিত্যবিজ্ঞানের অনুকরণে প্রবৃত্ত হইল, কিন্তু তবু সে রোমই রহিল, গ্রীস হইল না—সে আত্মপ্রকৃতিতেই সফল হইল, অনুকৃতিতে নহে—সে লোকসংস্থানকার্যে জগতের আদর্শ হইল সাহিত্য-বিজ্ঞান-কলাবিদ্যায় হইল না।

ইহা হইতে বুঝিতে হইবে, উৎকর্ষের একমাত্র আকার ও একমাত্র উপায় জগতে নাই। আজ য়ুরোপীয় প্রতাপের যে আদর্শ আমাদের চক্ষের সমক্ষে অভ্রভেদী হইয়া উঠিয়াছে উন্নতি তাহা ছাড়াও সম্পূর্ণ অন্য আকারে হইতে পারে—আমাদের ভারতীয় উৎকর্ষের যে আদর্শ আমরা দেখিয়াছি তাহার মধ্যে প্রাণসঞ্চার বলসঞ্চার করিলে জগতের মধ্যে আমাদিগকে লজ্জিত থাকিতে হইবে না। একদিন ভারতবর্ষ জ্ঞানের দ্বারা, ধর্মের দ্বারা চীন-জাপান ব্রহ্মদেশ-শ্যামদেশ তিব্বত-মঙ্গোলিয়া—এশিয়া মহাদেশের অধিকাংশই জয় করিয়াছিল। আজ য়ুরোপ অস্ত্রের দ্বারা বাণিজ্যের দ্বারা পৃথিবী জয় করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। আমরা ইস্কুলে পড়িয়া এই আধুনিক য়ুরোপের প্রণালীকেই যেন একমাত্র গৌরবের কারণ বলিয়া মনে না করি।

কিন্তু ইংরেজের বাহুবল নহে—ইংরেজের ইস্কুল ঘরে-বাইরে দেহে-মনে আচারে-বিচারে সর্বত্র আমাদিগকে আক্রমণ করিয়াছে। আমাদিগকে যে-সকল বিজাতীয় সংস্কারের দ্বারা আচ্ছন্ন করিতেছে তাহাতে অন্তত কিছুকালের জন্যও আমাদের আত্মপরিচয়ের পথ লোপ করিতেছে। সে আত্মপরিচয় ব্যতীত আমাদের কখনোই আত্মোন্নতি হইতে পারে না।

ভারতবর্ষের দেশীয় রাজ্যগুলির যথার্থ উপযোগিতা কী তাহা এইবার বলিবার সময় উপস্থিত হইল। দেশবিদেশের লোক বলিতেছে, ভারতবর্ষের দেশীয় রাজ্যগুলি পিছাইয়া পড়িতেছে। জগতের উন্নতির যাত্রাপথে পিছাইয়া পড়া ভালো নহে, এ কথা সকলেই স্বীকার করিবে, কিন্তু অগ্রসর হইবার সকল উপায়ই সমান মঙ্গলকর নহে। নিজের শক্তির দ্বারাই অগ্রসর হওয়াই যথার্থ অগ্রসর হওয়া—তাহাতে যদি মন্দগতিতে যাওয়া যায় তবে সে ভালো। অপর ব্যক্তির কোলে-পিঠে চড়িয়া অগ্রসর হওয়ার কোনো মাহাত্ম্য নাই—কারণ, চলিবার শক্তিলাভই যথার্থ লাভ, অগ্রসর হওয়ামাত্রই লাভ নহে। ব্রিটিশ-রাজ্যে আমরা যেটুকু অগ্রসর হইতে পারিয়াছি তাহাতে আমাদের কৃতকার্যতা কতটুকু! সেখানকার শাসনরক্ষণ-বিধিব্যবস্থা যত ভালোই হউক-না কেন, তাহা তো বস্তুত আমাদের নহে। মানুষ ভুলত্রুটি-ক্ষতিক্লেশের মধ্য দিয়াই পূর্ণতার পথে অগ্রসর হয়। কিন্তু আমাদিগকে ভুল করিতে দিবার ধৈর্য যে ব্রিটিশ-রাজের নাই। সুতরাং তাঁহারা আমাদিগকে ভিক্ষা দিতে পারেন, শিক্ষা দিতে পারেন না। তাঁহাদের নিজের যাহা আছে তাহার সুবিধা আমাদিগকে দিতে পারেন, কিন্তু তাহার স্বত্ব দিতে পারেন না। মনে করা যাক কলিকাতা ম্যুনিসিপ্যালিটির পূর্ববর্তী কমিশনারগণ পৌরকার্যে স্বাধীনতা পাইয়া যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখাইতে পারেন নাই, সেই অপরাধে অধীর হইয়া কর্তৃপক্ষ তাঁহাদের স্বাধীনতা হরণ করিলেন। হইতে পারে এখন কলিকাতার পৌরকার্য পূর্বের চেয়ে ভালোই চলিতেছে, কিন্তু এরূপ ভালো চলাই যে সর্বাপেক্ষা ভালো তাহা বলিতে পারি না। আমাদের নিজের শক্তিতে ইহা অপেক্ষা খারাপ চলাও আমাদের পক্ষে ইহার চেয়ে ভালো। আমরা গরিব এবং নানা বিষয়ে অক্ষম; আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্য ধনী জ্ঞানী বিলাতের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত তুলনীয় নহে বলিয়া শিক্ষাবিভাগের দেশীয় লোকের কর্তৃত্ব খর্ব করিয়া রাজা যদি নিজের জোরে কেম্‌ব্রিজ-অক্‌সফোর্ডের নকল প্রতিমা গড়িয়া তোলেন, তবে তাহাতে আমাদের কতটুকুই বা শ্রেয় আছে—আমরা গরিবের যোগ্য বিদ্যালয় যদি নিজে গড়িয়া তুলিতে পারি তবে সেই আমাদের সম্পদ। যে ভালো আমার আয়ত্ত নহে সে ভালোকে আমার মনে করাই মানুষের পক্ষে বিষম বিপদ। অল্পদিন হইল একজন বাঙালি ডেপুটি-ম্যাজিস্ট্রেট দেশীয় রাজ্যশাসনের প্রতি নিতান্ত অবজ্ঞা প্রকাশ করিতেছিলেন—তখন স্পষ্টই দেখিতে পাইলাম তিনি মনে করিতেছেন, ব্রিটিশ-রাজ্যের সুব্যবস্থা সমস্তই যেন তাঁহাদেরই সুব্যবস্থা; তিনি যে ভারবাহীমাত্র, তিনি যে যন্ত্রী নহেন, যন্ত্রের একটা সামান্য অঙ্গমাত্র, এ কথা যদি তাঁহার মনে থাকিত তবে দেশীয় রাজ্যব্যবস্থার প্রতি এমন স্পর্ধার সহিত অবজ্ঞা প্রকাশ করিতে পারিতেন না। ব্রিটিশ-রাজ্যে আমরা যাহা পাইতেছি তাহা যে আমাদের নহে, এই সত্যটি ঠিকমত বুঝিয়া উঠা আমাদের পক্ষে