প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
|
![]() |
বিলাতি সভ্যতার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গই অনেক টাকার ধন। আমোদ হইতে লড়াই পর্যন্ত সমস্তই টাকার ব্যাপার। ইহাতে টাকা একটা প্রকাণ্ড শক্তি হইয়া উঠিয়াছে এবং টাকার পূজা আর-সমস্ত পূজাকে ছাড়াইয়া চলিয়াছে।
এই দুঃসাধ্যতা, দুর্লভতা, জটিলতা য়ুরোপীয় সভ্যতার সর্বপ্রধান দুর্বলতা। সাঁতার দিতে গিয়া অত্যন্ত বেশি হাত-পা ছোঁড়া অপটুতারই প্রমাণ দেয়; কোনো সভ্যতার মধ্যে যখন সর্ব বিষয়েই প্রয়াসের একান্ত আতিশয্য দেখা যায় তখন ইহা বুঝিতে হইবে, তাহার যতটা শক্তি বাহিরে দেখা যাইতেছে তাহার অনেকটারই প্রতিমুহূর্তে অপব্যয় হইতেছে। বিপুল মালমসলা-কাঠখড়ের হিসাব যদি ঠিকমতো রাখা যায় তবে দেখা যাইবে, মজুরি পোষাইতেছে না। প্রকৃতির খাতায় সুদে-আসলে হিসাব বাড়িতেছে, মাঝে মাঝে তাগিদের পেয়াদাও যে আসিতেছে না তাহাও নহে—কিন্তু, সে লইয়া আমাদের চিন্তা করিবার দরকার নাই।
আমাদের ভাবনার বিষয় এই যে, দেশে বিচার দুর্মূল্য, অন্ন দুর্মূল্য, শিক্ষাও যদি দুর্মূল্য হয়, তবে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে নিদারুণ বিচ্ছেদ আমাদের দেশেও অত্যন্ত বৃহৎ হইয়া উঠিবে। বিলাতে দারিদ্র্য কেবল ধনের অভাব নহে, তাহা মনুষ্যত্বেরও অভাব—কারণ, সেখানে মনুষ্যত্বের সমস্ত উপকরণই চড়া দরে বিক্রয় হয়। আমাদের দেশে দরিদ্রের মধ্যে মনুষ্যত্ব ছিল, কারণ, আমাদের সমাজে সুখ স্বাস্থ্য শিক্ষা আমোদ মোটের উপরে সকলে ভাগাভাগি করিয়া লইয়াছেন। ধনীর চণ্ডীমণ্ডপে যে পাঠশালা বসিয়াছে গরিবের ছেলেরা বিনা বেতনে তাহাতে শিক্ষা পাইয়াছে; রাজার সভায় যে উৎসব হইয়াছে দরিদ্র প্রজা বিনা আহ্বানে তাহাতে প্রবেশলাভ করিয়াছে। ধনীর বাগানে দরিদ্র প্রত্যহ পূজার ফুল তুলিয়াছে, কেহ তাহাকে পুলিসে দেয় নাই; সম্পন্ন ব্যক্তি দিঘি-ঝিল কাটাইয়া তাহার চারি দিকে পাহারা বসাইয়া রাখে নাই। ইহাতে দরিদ্রের আত্মসম্ভ্রম ছিল, ধনীর ঐশ্বর্যে তাহার স্বাভাবিক দাবি ছিল, এইজন্য তাহার অবস্থা যেমনই হউক সে পাশবতা প্রাপ্ত হয় নাই—যাঁহারা জাতিভেদ ও মনুষ্যত্বের উচ্চ অধিকার লইয়া মুখস্থ বুলি আওড়ান তাঁহারা এ-সব কথা ভালো করিয়া চিন্তা করিয়া দেখেন না।
বিলাতি লাট আজকাল বলিতেছেন, যাহার টাকা নাই, ক্ষমতা নাই, তাহার বিদ্যাশিক্ষার প্রতি অত্যন্ত লোভ করিবার দরকার কী? আমাদের কানে এ কথাটা অত্যন্ত বিদেশী, অত্যন্ত নিষ্ঠুর বলিয়া ঠেকে।
কিন্তু সমস্ত সহিতে হইবে। তাই বলিয়া বসিয়া বসিয়া আক্ষেপ করিলে চলিবে না।
আমরা নিজেরা যাহা করিতে পারি তাহারই জন্য আমাদিগকে কোমর বাঁধিতে হইবে। বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা আমাদের দেশে সমাজের ব্যবস্থা ছিল—রাজার উপরে, বাহিরের সাহায্যের উপরে ইহার নির্ভর ছিল না—সমাজ ইহাকে রক্ষা করিয়াছে এবং সমাজকে ইহা রক্ষা করিয়াছে।
এখন বিদ্যাশিক্ষা রাজার কাজ পাইবার সহায়স্বরূপ হইয়াছে, তখন বিদ্যাশিক্ষা সমাজের হিতসাধনের উপযোগী ছিল। এখন সমাজের সহিত বিদ্যার পরস্পর সহায়তার যোগ নাই। ইহাতে এতকাল পরে শিক্ষাসাধনব্যাপার ভারতবর্ষে রাজার প্রসাদ-অপেক্ষী হইয়াছে।
এ অবস্থায় রাজা যদি মনে করেন, তাঁহাদের রাজ-পলিসির অনুকূল করিয়াই শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে, রাজভক্তির ছাঁচে ঢালিয়া ইতিহাস রচিত হইবে, বিজ্ঞানশিক্ষাটাকে পাকে-প্রকারে খর্ব করিতে হইবে, ভারতবর্ষীয় ছাত্রের সর্বপ্রকার আত্মগৌরবকে সংকুচিত করিতে হইবে, তবে তাঁহাদিগকে দোষ দেওয়া যায় না—কর্তার ইচ্ছায় কর্ম—আমরা সে কর্মের ফলভোগ করিব, কিন্তু সে কর্মের উপরে কর্তৃত্ব করিবার আশা করিব কিসের জোরে।
তা ছাড়া, বিদ্যা জিনিসটা কলকারখানার সামগ্রী নহে। তাহা মনের ভিতর হইতে না দিলে দিবার জো নাই। লাটসাহেব তাঁহার অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজের আদর্শ লইয়া কেবলই আস্ফালন করিয়াছেন, এ কথা ভুলিয়াছেন যে সেখানে ছাত্র ও অধ্যাপকের মধ্যে ব্যবধান নাই, সুতরাং সেখানে বিদ্যার আদানপ্রদান স্বাভাবিক। শিক্ষক সেখানে বিদ্যাদানের জন্য উন্মুখ এবং ছাত্রেরাও