ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ
আবিরেলপনকে চরিত্রের একটা চিরস্থায়ী কলঙ্ক বলিয়া গণ্য করিয়াছে—এতবড়ো শিক্ষিত-মূর্খতার প্রমাণ আমরা পাইয়াছি।

এ রোগের সমস্ত উপসর্গ যে একেবারে কাটিয়াছে তাহা বলিতে পারি না, কিন্তু আরোগ্যের লক্ষণ দেখা দিয়াছে। আজকাল আমরা ইংরেজি ছাপাখানার দ্বারে ধন্না না দিয়া নিজে সন্ধান করিতে, নিজে যাচাই করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, এমন-কি, পুঁথির প্রতিবাদ করিতেও সাহস হয়।

নিজের মধ্যে এই-যে একটা স্বাতন্ত্র্যের অনুভূতি, যে অনুভূতি না থাকিলে শক্তির যথার্থ স্ফূর্তি হইতে পারে না, ইহা কোনো একটা দিকে আরম্ভ করিলে ক্রমে সকল দিকেই আপনাকে প্রকাশ করিতে থাকে। ধর্মে কর্মে সমাজে সর্বত্র আমরা ইহার পরিচয় পাইতেছি। কিছুকাল পূর্বে আমাদের দেশের শাস্ত্র এবং শাসন সমস্তই আমরা খ্রীস্টান পাদরির চোখে দেখিতাম—পাদরির কষ্টিপাথরে কোন্‌টিতে কী রকম দাগ পড়িতেছে, ইহাই আলোচনা করিয়া দেশের সমস্ত জিনিসকে বিচার করিতে হইত।

প্রথম-প্রথম সে বিচারে দেশের কোনো জিনিসেরই মূল্য ছিল না। তার পরে মাঝে আর-একটু ভালো লক্ষণ দেখা দিল। তখন আমরা বিলিতি গুরুকে বলিতে লাগিলাম, তোমাদের দেশে যা-কিছু গৌরবের বিষয় আছে আমাদের দেশেও তা সমস্তই ছিল; আমাদের দেশে রেলগাড়ি এবং বেলুন ছিল শাস্ত্রে তাহারই প্রমাণ আছে এবং ঋষিরা জানিতেন সূর্যালোকে গাছপালা অক্সিজেন নিশ্বাস পরিত্যাগ করে, সেইজন্যেই প্রাতঃকালে পূজার পুষ্পচয়নের বিধান হইয়াছে। এ কথা বলিবার সাহস ছিল না যে, রেলগাড়ি-বেলুন না থাকিলেও গৌরবের কারণ থাকিতে পারে এবং ফাঁকি দিয়া অক্সিজেন বাষ্প গ্রহণ করানোর চেয়ে নির্মল প্রত্যুষে সর্বকর্মারম্ভে সুন্দরভাবে দেবতার সেবায় লোকের মনকে নিযুক্ত করিবার মাহাত্ম্য অধিক।

এখনো এ ভাবটা আমরা যে সম্পূর্ণ ত্যাগ করিতে পারিয়াছি, তা নয়। এ কথা এখনো সম্পূর্ণ ভুলিতে পারি নাই যে, পাদরির কষ্টিপাথরে যাহা উজ্জ্বল দাগ দেয় তাহা মূল্যবান হইতে পারে, কিন্তু জগতে সোনাই তো একমাত্র মূল্যবান পদার্থ নয়; পাথরে কিছুমাত্র দাগ টানে না, এমন মূল্যবান জিনিসও জগতে আছে। যাহা হউক, বন্ধন শিথিল হইতেছে। আজকাল অল্প অল্প করিয়া এ কথা বলিতে আমরা সাহস করিতেছি যে, পাদরির বিচারে যাহা নিন্দনীয়, বিলাতের বিধানে যাহা গর্হিত, আমাদের দিক হইতে তাহার পক্ষে বলিবার কথা অনেক আছে।

আমরা যাহাকে পলিটিক্‌স্‌ বলি তাহার মধ্যেও এই ভাবটা দেখিতে পাই। প্রথমে যাহা সানুনয় প্রসাদভিক্ষা ছিল দ্বিতীয় অবস্থাতে তাহার ঝুলি খসে নাই, কিন্তু তাহার বুলি অন্যরকম হইয়া গেছে—ভিক্ষুকতা যতদূর পর্যন্ত উদ্ধত স্পর্ধার আকার ধারণ করিতে পারে তাহা করিয়াছে। আমাদের আধুনিক আন্দোলনগুলিকে আমরা বিলাতি রাষ্ট্রনৈতিক ক্রিয়াকলাপের অনুরূপ মনে করিয়া উৎসাহবোধ করিতেছি।

তৃতীয় অবস্থায় আমরা ইহার উপরের ধাপে উঠিবার চেষ্টা করিতেছি। এ কথা বলিতে শুরু করিয়াছি যে, হাতজোড় করিয়াই ভিক্ষা করি আর চোখ রাঙাইয়াই ভিক্ষা করি, এত সহজ উপায়ে গৌরবলাভ করা যায় না-দেশের জন্য স্বাধীন শক্তিতে যতটুকু কাজ নিজে করিতে পারি তাহাতে দুই দিকে লাভ—এক তো ফললাভ, দ্বিতীয়ত নিজে কাজ করাটাই একটা লাভ, সেটা ফললাভের চেয়ে বেশি বৈ কম নয়—সেই গৌরবের প্রতি লক্ষ করিয়াই আমাদের দেশের গুরু বলিয়াছেন, ফলের প্রতি আসক্তি না রাখিয়া কর্ম করিবে। ভিক্ষার অগৌরব এই যে, ফললাভ হইলেও নিজের শক্তি নিজে খাটাইবার যে সার্থকতা তাহা হইতে বঞ্চিত হইতে হয়।

যাহা হউক, ইহা দেখা যাইতেছে যে, সকল দিক দিয়াই আমরা নিজের স্বাধীন শক্তির গৌরব অনুভব করিবার একটা উদ্যম অন্তরের মধ্যে অনুভব করিতেছি—সাহিত্য হইতে আরম্ভ করিয়া পলিটিক্‌স্‌ পর্যন্ত কোথাও ইহার বিচ্ছেদ নাই।

ইহার একটা ফল এই দেখিতেছি, পূর্বে ইংরেজি শিক্ষা আমাদের দেশে প্রাচীন নবীন, শিক্ষিত অশিক্ষিত, উচ্চ নীচ, ছাত্র ও সংসারীর মধ্যে যে একটা বিচ্ছেদের সৃষ্টি করিয়াছিল এখন তাহার উল্‌টা কাজ আরম্ভ হইয়াছে, এখন আবার আমরা নিজেদের