ভারতবর্ষীয় সমাজ

এইখানেই আমাদের অধঃপতন হইয়াছে. এইখানেই বর্তমান য়ুরোপীয় সভ্যতা বর্তমান হিন্দুসভ্যতাকে জিতিয়াছে।

য়ুরোপের নেশন একটি সজীব সত্তা। অতীতের সহিত নেশনের বর্তমানের যে কেবল জড় সম্বন্ধ, তাহা নহে—পূর্বপুরুষ প্রাণপাত করিয়া কাজ করিয়াছে এবং বর্তমান পুরুষ চোখ বুজিয়া ফলভোগ করিতেছে, তাহা নহে। অতীত-বর্তমানের মধ্যে নিরন্তর চিত্তের সম্বন্ধ আছে—অখণ্ড কর্মপ্রবাহ চলিয়া আসিতেছে। এক অংশ প্রবাহিত,আর-এক অংশ বদ্ধ, এক অংশ প্রজ্বলিত, অপরাংশ নির্বাপিত, এরূপ নহে। সে হইলে তো সম্বন্ধবিচ্ছেদ হইয়া গেল—জীবনের সহিত মৃত্যুর কী সম্পর্ক?

কেবলমাত্র অলস ভক্তিতে যোগসাধন করে না—বরং তাহাতে দূরে লইয়া যায়। ইংরেজ যাহা পরে, যাহা খায়, যাহা বলে, যাহা করে, সবই ভালো, এই ভক্তিতে আমাদিগকে অন্ধ অনুকরণে প্রবৃত্ত করে—তাহাতে আসল ইংরেজত্ব হইতে আমাদিগকে দূরে লইয়া যায়। কারণ ইংরেজ এরূপ নিরুদ্যম অনুকরণকারী নহে। ইংরেজ স্বাধীন চিন্তা ও চেষ্টার জোরেই বড়ো হইয়াছে—পরের গড়া জিনিস অলসভাবে ভোগ করিয়া তাহারা ইংরেজ হইয়া উঠে নাই। সুতরাং ইংরেজ সাজিতে গেলেই প্রকৃত ইংরেজত্ব আমাদের পক্ষে দুর্লভ হইবে।

তেমনি আমাদের পিতামহেরা যে বড়ো হইয়াছিলেন সে কেবল আমাদের প্রপিতামহদের কোলের উপরে নিশ্চলভাবে শয়ন করিয়া নহে। তাঁহারা ধ্যান করিয়াছেন, বিচার করিয়াছেন, পরীক্ষা করিয়াছেন, পরিবর্তন করিয়াছেন, তাঁহাদের চিত্তবৃত্তি সচেষ্ট ছিল, সেইজন্যই তাঁহারা বড়ো হইতে পারিয়াছেন। আমাদের চিত্ত যদি তাঁহাদের সেই চিত্তের সহিত যোগযুক্ত না হয়, কেবল তাঁহাদের কৃতকর্মের সহিত আমাদের জড় সম্বন্ধ থাকে, তবে আমাদের আর ঐক্য নাই। পিতামাতার সহিত পুত্রের জীবনের যোগ আছে—তাঁহাদের মৃত্যু হইলেও জীবনক্রিয়া পুত্রের দেহে একই রকমে কাজ করে। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষের মানসী শক্তি যেভাবে কাজ করিয়াছে, আমাদের মনে যদি তাহার কোনো নিদর্শন না পাই—আমরা যদি কেবল তাঁহাদের অবিকল অনুকরণ করিয়া চলি, তবে বুঝিব আমাদের মধ্যে আমাদের পূর্বপুরুষ আর সজীব নাই। শণের দাড়ি-পরা যাত্রার নারদ যেমন দেবর্ষি নারদ, আমরাও তেমনি আর্য। আমরা একটা বড়োরকমের যাত্রার দল—গ্রাম্যভাষায় এবং কৃত্রিম সাজ-সরঞ্জামে পূর্বপুরুষ সাজিয়া অভিনয় করিতেছি।

পূর্বপুরুষদের সেই চিত্তকে আমাদের জড় সমাজের উপর জাগাইয়া তুলিলে তবেই আমরা বড়ো হইব। আমাদের সমস্ত সমাজ যদি প্রাচীন মহৎ স্মৃতি ও বৃহৎ ভাবের দ্বারা আদ্যোপান্ত সজীব সচেষ্ট হইয়া উঠে, নিজের সমস্ত অঙ্গে প্রত্যঙ্গে বহুশতাব্দীর জীবনপ্রবাহ অনুভব করিয়া আপনাকে সবল ও সচল করিয়া তোলে, তবে রাষ্ট্রীয় পরাধীনতা ও অন্য সকল দুর্গতি তুচ্ছ হইয়া যাইবে। সমাজের সচেষ্ট স্বাধীনতা অন্য সকল স্বাধীনতা হইতেই বড়ো।

জীবনের পরিবর্তন বিকাশ, মৃত্যুর পরিবর্তন বিকার। আমাদের সমাজেও দ্রুতবেগে পরিবর্তন চলিতেছে, কিন্তু সমাজের অভ্যন্তরে সচেতন অন্তঃকরণ নাই বলিয়া সে-পরিবর্তন বিকার ও বিশ্লেষণের দিকে যাইতেছে-কেহ তাহা ঠেকাইতে পারিতেছে না।

সজীব পদার্থ সচেষ্টভাবে বাহিরের অবস্থাকে নিজের অনুকূল করিয়া আনে—আর নির্জীব পদার্থকে বাহিরের অবস্থাই সবলে আঘাত করিয়া নিজের আয়ত্ত করিয়া লয়। আমাদের সমাজে যাহা-কিছু পরিবর্তন হইতেছে, তাহাতে চেতনার কার্য নাই; তাহাতে বাহিরের সঙ্গে ভিতরের সঙ্গে কোনো সামঞ্জস্যচেষ্টা নাই—বাহির হইতে পরিবর্তন ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়িতেছে এবং সমাজের সমস্ত সন্ধি শিথিল করিয়া দিতেছে।

নূতন অবস্থা, নূতন শিক্ষা, নূতন জাতির সহিত সংঘর্ষ—ইহাকে অস্বীকার করা যায় না। আমরা যদি এমনভাবে চলিতে ইচ্ছা করি, যেন ইহারা নাই, যেন আমরা তিন সহস্র বৎসর পূর্বে বসিয়া আছি, তবে সেই তিন সহস্র বৎসর পূর্বকার অবস্থা আমাদিগকে কিছুমাত্র সাহায্য করিবে না এবং বর্তমান পরিবর্তনের বন্যা আমাদিগকে ভাসাইয়া লইয়া যাইবে। আমরা বর্তমানকে স্বীকারমাত্র না করিয়া পূর্বপুরুষের দোহাই মানিলে তো পূর্বপুরুষ সাড়া দিবেন না। আমাদের পূর্বপুরুষ আমাদের দোহাই পাড়িয়া বলিতেছেন,