আত্মপরিচয় ১
শ্রোতৃবর্গের দিকে চাহিয়া চোখ টিপিলেন ; স্নিগ্ধ কৌতুকের সঙ্গে একটুখানি হাসিলেন এবং আমারই কথার ভিতর দিয়া কী-সব নিজের কথা বলিয়া লইলেন।

কে কেমন বোঝে অর্থ তাহার,

কেহ এক বলে, কেহ বলে আর,

আমারে শুধায় বৃথা বার বার —

দেখে তুমি হাস বুঝি।

কে গো তুমি, কোথা রয়েছে গোপনে

আমি মরিতেছি খুঁজি।

শুধু কি কবিতা-লেখার একজন কর্তা কবিকে অতিক্রম করিয়া তাহার লেখনী চালনা করিয়াছেন? তাহা নহে। সেইসঙ্গে ইহাও দেখিয়াছি যে, জীবনটা যে গঠিত হইয়া উঠিতেছে, তাহার সমস্ত সুখদুঃখ, তাহার সমস্ত যোগবিয়োগের বিচ্ছিন্নতাকে কে একজন একটি অখণ্ড তাৎপর্যের মধ্যে গাঁথিয়া তুলিতেছেন। সকল সময়ে আমি তাঁহার আনুকূল্য করিতেছি কি না জানি না, কিন্তু আমার সমস্ত বাধা-বিপত্তিকেও, আমার সমস্ত ভাঙাচোরাকেও তিনি নিয়তই গাঁথিয়া জুড়িয়া দাঁড় করাইতেছেন। কেবল তাই নয়, আমার স্বার্থ, আমার প্রবৃত্তি, আমার জীবনকে যে অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ করিতেছে তিনি বারে বারে সে সীমা ছিন্ন করিয়া দিতেছেন — তিনি সুগভীর বেদনার দ্বারা, বিচ্ছেদের দ্বারা, বিপুলের সহিত, বিরাটের সহিত তাহাকে যুক্ত করিয়া দিতেছেন। সে যখন একদিন হাট করিতে বাহির হইয়াছিল তখন বিশ্বমানবের মধ্যে সে আপনার সফলতা চায় নাই — সে আপনার ঘরের সুখ ঘরের সম্পদের জন্যই কড়ি সংগ্রহ করিয়াছিল। কিন্তু সেই মেঠো পথ, সেই ঘোরো সুখদুঃখের দিক হইতে কে তাহাকে জোর করিয়া পাহাড়-পর্বত অধিত্যকা-উপত্যকার দুর্গমতার মধ্য দিয়া টানিয়া লইয়া যাইতেছে।

এ কী কৌতুক নিত্য-নূতন

ওগো কৌতুকময়ী!

যে দিকে পান্থ চাহে চলিবারে

চলিতে দিতেছে কই?

গ্রামের যে পথ ধায় গৃহপানে,

চাষিগণ ফিরে দিবা-অবসানে,

গোঠে ধায় গোরু, বধূ জল আনে

শতবার যাতায়াতে —

একদা প্রথম প্রভাতবেলায়

সে পথে বাহির হইনু হেলায়,

মনে ছিল দিন কাজে ও খেলায়

কাটায়ে ফিরিব রাতে।

পদে পদে তুমি ভুলাইলে দিক,

কোথা যাব আজি নাহি পাই ঠিক,

ক্লান্ত হৃদয় ভ্রান্ত পথিক