পাগল
ক্ষণে ক্ষণে তাহার পরিচয় পাই মাত্র। অহরহই জীবনকে মৃত্যু নবীন করিতেছে, ভালোকে মন্দ উজ্জ্বল করিতেছে, তুচ্ছকে অভাবনীয় মূল্যবান করিতেছে। যখন পরিচয় পাই তখনি রূপের মধ্যে অপরূপ, বন্ধনের মধ্যে মুক্তির প্রকাশ, আমাদের কাছে জাগিয়া উঠে।

আজিকার এই মেঘোন্মুক্ত আলোকের মধ্যে আমার কাছে সেই অপরূপের মূর্তি জাগিয়াছে। সম্মুখের ঐ রাস্তা, ঐ খোড়ো - চাল - দেওয়া মুদির দোকান, ঐ ভাঙা ভিটা, ঐ সরু গলি, ঐ গাছপালাগুলিকে প্রতিদিনের পরিচয়ের মধ্যে অত্যন্ত তুচ্ছ করিয়া দেখিয়াছিলাম। এইজন্য উহারা আমাকে বদ্ধ করিয়া ফেলিয়াছিল–রোজ এই কটা জিনিসের মধ্যেই নজরবন্দী করিয়া রাখিয়াছিল। আজ হঠাৎ তুচ্ছতা একেবারে চলিয়া গেছে। আজ দেখিতেছি, চির - অপরিচিতকে এতদিন পরিচিত বলিয়া দেখিতেছিলাম, ভালো করিয়া দেখিতেছিলামই না। আজ এই যাহা - কিছু সমস্তকেই দেখিয়া শেষ করিতে পারিতেছি না। আজ সেই - সমস্তই আমার চারিদিকে আছে, অথচ তাহারা আমাকে আটক করিয়া রাখে নাই, তাহারা প্রত্যেকেই আমাকে পথ ছাড়িয়া দিয়াছে। আমার পাগল এইখানেই ছিলেন–সেই অপূর্ব, অপরিচিত অপরূপ, এই মুদির দোকানের খোড়ো চালের শ্রেণীকে অবজ্ঞা করেন নাই–কেবল, যে আলোকে তাহাকে দেখা যায় সে আলোক আমার চোখের উপরে ছিল না। আজ আশ্চর্য এই যে, ঐ সম্মুখের দৃশ্য, ঐ কাছের জিনিস আমার কাছে একটি বহু সুদূরের মহিমা লাভ করিয়াছে। উহার সঙ্গ গৌরীশংকরের তুষারবেষ্টিত দুর্গমতা, মহাসমুদ্রের তরঙ্গচঞ্চল দুস্তরতা আপনাদের সজাতিত্ব জ্ঞাপন করিতেছে।

এমনি করিয়া হঠাৎ এক দিন জানিতে পারা যায়, যাহার সঙ্গ অত্যন্ত ঘরকন্যা পাতাইয়া বসিয়াছিলাম সে আমার ঘরকন্যার বাহিরে। আমি যাহাকে প্রতি মুহূর্তে বাঁধা - বরাদ্দ বলিয়া নিতান্ত নিশ্চিন্ত হইয়াছিলাম তাহার মতো দুর্লভ দুরায়ত্ত জিনিস কিছুই নাই। আমি যাহাকে ভালো রূপ জানি মনে করিয়া তাহার চারিদিকে সীমানা আঁকিয়া দিয়া খাতির - জমা হইয়া বসিয়াছিলাম, সে দেখি কখনো এক মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত সীমানা পার হইয়া অপূর্বরহস্যময় হইয়া উঠিয়াছে। যাহাকে নিয়মের দিক দিয়া, স্থিতির দিক দিয়া বেশ ছোটোখাটো, বেশ দস্তুর - সংগত, বেশ আপনার বলিয়াই বোধ হইয়াছিল, তাহাকে ভাঙনের দিক হইতে, ঐ শ্মশানচারী পাগলের তরফ হইতে হঠাৎ দেখিতে পাইলে মুখে আর বাক্য সরে না–আশ্চর্য! ও কে! যাহাকে চিরদিন জানিয়াছি সেই, এ কে! যে এক দিকে ঘরের সে আর - এক দিকে অন্তরের, যে এক দিকে কাজের সে আর - এক দিকে সমস্ত আবশ্যকের বাহিরে যাহাকে এক দিকে স্পর্শ করিতেছি সে আর - এক দিকের সমস্ত আয়ত্তের অতীত–যে এক - দিকে সকলের সঙ্গ বেশ খাপ খাইয়া গিয়াছে সে আর - এক দিকে ভয়ংকর খাপছাড়া, আপনাতে আপনি।

প্রতিদিন যাঁহাকে দেখি নাই আজ তাঁহাকে দেখিলাম, প্রতিদিনের হাত হইতে মুক্তিলাভ করিয়া বাঁচিলাম। আমি ভাবিতেছিলাম চারিদিকের পরিচিতের বেড়ার মধ্যে প্রাত্যহিক নিয়মের দ্বারা আমি বাঁধা, আজ দেখিতেছি মহা - অপূর্বের কোলের মধ্যে চিরদিন আমি খেলা করিতেছি। আমি ভাবিতেছিলাম আপিসের বড়োসাহেবের মতো অত্যন্ত একজন সুগম্ভীর হিসাবি লোকের হাতে পড়িয়া সংসারের প্রত্যহ আঁক পাড়িয়া যাইতেছি, আজ সেই বড়ো - সাহেবের চেয়ে যিনি বড়ো সেই মস্ত বেহিসেবি পাগলের বিপুল উদার অট্টহাস্য জলে সহলে আকাশে সপ্তলোক ভেদ করিয়া ধ্বনিত শুনিয়া হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। আমার খাতাপত্র সমস্ত রহিল। আমার জরুরি কাজের বোঝা ঐ সৃষ্টি ছাড়ার পায়ের কাছে ফেলিয়া দিলাম–তাঁহার তান্ডব নৃত্যের আঘাতে তাহা চূর্ণ চূর্ণ হইয়া ধূলি হইয়া উড়িয়া যাক।