বৈজ্ঞানিক কৌতূহল
অবধৌতিক ঔষধের আকর্ষণ অধিক। তাহার ফল যে কত দূর পর্যন্ত হইতে পারে তৎসম্বন্ধে আমাদের প্রত্যাশা সীমাবদ্ধ নহে। মানুষের যত অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি হইতে থাকে, অমোঘ নিয়মের লৌহপ্রাচীরে যতই সে আঘাত প্রাপ্ত হয়, ততই মানুষ নিজের স্বাভাবিক অনন্ত আশাকে সীমাবদ্ধ করিয়া আনে, কৌতূহলবৃত্তির স্বাভাবিক নূতনত্বের আকাঙ্ক্ষা সংযত করিয়া আনে, নিয়মকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করে এবং প্রথমে অনিচ্ছাক্রমে পরে অভ্যাসক্রমে তাহার প্রতি একটা রাজভক্তির উদ্রেক করিয়া তোলে।

ব্যোম কহিল–কিন্তু সে ভক্তি যথার্থ অন্তরের ভক্তি নহে, তাহা কাজ আদায়ের ভক্তি। যখন নিতান্ত নিশ্চয় জানা যায় যে, জগৎকার্য অপরিবর্তনীয় নিয়মে বদ্ধ, তখন কাজেই পেটের দায়ে প্রাণের দায়ে তাহার নিকট ঘাড় হেঁট করিতে হয়; তখন বিজ্ঞানের বাহিরে অনিশ্চয়ের হস্তে আত্মসমর্পণ করিতে সাহস হয় না; তখন মাদুলি তাগা জল-পড়া প্রভৃতিকে গ্রহণ করিতে হইলে ইলেক্র‌ট্রিসিটি, ম্যাগ্নেটিজ্‌ম্‌, হিপ্‌নটিজ্‌ম্‌ প্রভৃতি বিজ্ঞানের জাল মার্কা দেখিয়া আপনাকে ভুলাইতে হয়। আমরা নিয়ম অপেক্ষা অনিয়মকে যে ভালোবাসি তাহার একটা গোড়ার কারণ আছে। আমাদের নিজের মধ্যে এক জায়গায় আমরা নিয়মের বিচ্ছেদ দেখিতে পাই। আমাদের ইচ্ছাশক্তি সকল নিয়মের বাহিরে–সে স্বাধীন; অন্তত আমরা সেইরূপ অনুভব করি। আমাদের অন্তরপ্রকৃতিগত সেই স্বাধীনতার সাদৃশ্য বাহ্যপ্রকৃতির মধ্যে উপলব্ধি করিতে স্বভাবতই আমাদের আনন্দ হয়। ইচ্ছার প্রতি ইচ্ছার আকর্ষণ অত্যন্ত প্রবল; ইচ্ছার সহিত যে দান আমরা প্রাপ্ত হই সে দান আমাদের কাছে অধিকতর প্রিয়; সেবা যতই পাই তাহার সহিত ইচ্ছার যোগ না থাকিলে তাহা আমাদের নিকট রুচিকর বোধ হয় না। সেইজন্য, যখন জানিতাম যে, ইন্দ্র আমাদিগকে বৃষ্টি দিতেছেন, মরুৎ আমাদিগকে বায়ু যোগাইতেছেন, অগ্নি আমাদিগকে দীপ্তি দান করিতেছেন, তখন সেই জ্ঞানের মধ্যে আমাদের একটা আন্তরিক তৃপ্তি ছিল; এখন জানি, রৌদ্রবৃষ্টিবায়ুর মধ্যে ইচ্ছা-অনিচ্ছা নাই, তাহারা যোগ্য-অযোগ্য প্রিয়-অপ্রিয় বিচার না করিয়া নির্বিকারে যথানিয়মে কাজ করে; আকাশে জলীয় অণু শীতলবায়ুসংযোগে সংহত হইলেই সাধুর পবিত্র মস্তকে বর্ষিত হইয়া সর্দি উৎপাদন করিবে এবং অসাধুর কুষ্মাণ্ডমঞ্চে জলসিঞ্চন করিতে কুন্ঠিত হইবে না–বিজ্ঞান আলোচনা করিতে করিতে ইহা আমাদের ক্রমে একরূপ সহ্য হইয়া আসে, কিন্তু বস্তুত ইহা আমাদের ভালোই লাগে না।

আমি কহিলাম–পূর্বে আমরা যেখানে স্বাধীন ইচ্ছার কর্তৃত্ব অনুমান করিয়াছিলাম, এখন সেখানে নিয়মের অন্ধ শাসন দেখিতে পাই, সেইজন্য বিজ্ঞান আলোচনা করিলে জগৎকে নিরানন্দ ইচ্ছাসম্পর্কবিহীন বলিয়া মনে হয়। কিন্তু ইচ্ছা এবং আনন্দ যতক্ষণ আমার অন্তরে আছে, ততক্ষণ জগতের অন্তরে তাহাকে অনুভব করিতেই হইবে–পূর্বে তাহাকে যেখানে কল্পনা করিয়াছিলাম সেখানে না হউক, তাহার অন্তরতর অন্তরতম স্থানে তাহাকে প্রতিষ্ঠিত না জানিলে আমাদের অন্তরতম প্রকৃতির প্রতি ব্যভিচার করা হয়। আমার মধ্যে সমস্ত বিশ্বনিয়মের যে-একটি ব্যতিক্রম আছে, জগতে কোথাও তাহার একটা মূল আদর্শ নাই, ইহা আমাদের অন্তরাত্মা স্বীকার করিতে চাহে না। এইজন্য আমাদের ইচ্ছা একটা বিশ্ব-ইচ্ছার, আমাদের প্রেম একটা বিশ্বপ্রেমের নিগূঢ় অপেক্ষা না রাখিয়া বাঁচিতে পারে না।

সমীর কহিল–জড়প্রকৃতির সর্বত্রই নিয়মের প্রাচীর চীনদেশের প্রাচীরের অপেক্ষা দৃঢ়, প্রশস্ত ও অভ্রভেদী; হঠাৎ মানবপ্রকৃতির মধ্যে একটা ক্ষুদ্র ছিদ্র বাহির হইয়াছে, সেইখানে চক্ষু দিয়াই আমরা এক আশ্চর্য আবিষ্কার করিয়াছি, দেখিয়াছি প্রাচীরের পরপারে এক অনন্ত অনিয়ম রহিয়াছে; এই ছিদ্রপথে তাহার সহিত আমাদের যোগ; সেইখান হইতেই সমস্ত সৌন্দর্য স্বাধীনতা প্রেম আনন্দ প্রবাহিত হইয়া আসিতেছে। সেইজন্য এই সৌন্দর্য ও প্রেমকে কোনো বিজ্ঞানের নিয়মে বাঁধিতে পারিল না। এমন সময়ে স্রোতস্বিনী গৃহে প্রবেশ করিয়া সমীরকে কহিল–সেদিন দীপ্তির পিয়ানো বাজাইবার স্বরলিপি বইখানা তোমরা এত করিয়া খুঁজিতেছিলে, সেটার কী দশা হইয়াছে জান?

সমীর কহিল–না।