সৌন্দর্য সম্বন্ধে সন্তোষ
আড়াল করিতে পারে না, তাহার পক্ষে বড়োই মুশকিল। ভাই সমীর, তোমার আজিকার এই কথাটা ঠিক মনে লাগিতেছে–প্রতিবাদ না করিতে পারিয়া অত্যন্ত দুঃখিত আছি।

ব্যোম কহিল–কিছু প্রতিবাদ করিবার নাই তাহা বলিতে পারি না। সমীরের মতটা কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে বলা আবশ্যক। আসল কথাটা এই, আমরা অন্তর্জগৎবিহারী। বাহিরের জগৎ আমাদের নিকট প্রবল নহে। আমরা যাহা মনের মধ্যে গড়িয়া তুলি বাহিরের জগৎ তাহার প্রতিবাদ করিলে সে প্রতিবাদ গ্রাহ্যই করি না। যেমন ধূমকেতুর লঘু পুচ্ছটা কোনো গ্রহের পথে আসিয়া পড়িলে তাহার পুচ্ছেরই ক্ষতি হইতে পারে কিন্তু গ্রহ অপ্রতিহত ভাবে অনায়াসে চলিয়া যায়, তেমনি বহির্জগতের সহিত আমাদের অন্তর্জগতের রীতিমত সংঘাত কোনোকালে হয় না; হইলে বহির্জগৎটাই হঠিয়া যায়। যাহাদের কাছে হাতিটা অত্যন্ত প্রত্যক্ষ প্রবল সত্য, তাহারা গজেন্দ্রগমনের উপমায় গজেন্দ্রটাকে বেমালুম বাদ দিয়া কেবল গমনটুকুকে রাখিতে পারে না–গেজেন্দ্র বিপুল দেহ বিস্তারপূর্বক অটলভাবে কাব্যের পথরোধ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকে। কিন্তু আমাদের কাছে গজ বলো, গজেন্দ্র বলো, কিছুই কিছু নয়। সে আমাদের কাছে এত অধিক জাজ্বল্যমান নহে যে, তাহার গমনটুকু রাখিতে হইতে তাহাকে সুদ্ধ পুষিতে হইবে।

ক্ষিতি কহিল–আমরা অন্তরের বাঁশের কেল্লা বাঁধিয়া তীতুমীরের মতো বহিঃপ্রকৃতির সমস্ত ‘গোলা খা ডালা’–সেইজন্য গজেন্দ্র বলো, সুমেরু বলো, মেদিনী বলো, কিছুতেই আমাদিগকে হঠাইতে পারে না। কাব্যে কেন, জ্ঞানরাজ্যেও আমরা বহির্জগৎকে খাতিরমাত্র করি না। একটা সহজ উদাহরণ মনে পড়িতেছে। আমাদের সাত সুর ভিন্ন ভিন্ন পশুপক্ষীর কণ্ঠস্বর হইতে প্রাপ্ত, ভারতবর্ষীয় সংগীতশাস্ত্রে এই প্রবাদ বহুকাল চলিয়া আসিতেছে–এপর্যন্ত আমাদের ওস্তাদদের মনে এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহমাত্র উদয় হয় নাই, অথচ বহির্জগৎ হইতে প্রতিদিনই তাহার প্রতিবাদ আমাদের কানে আসিতেছে। স্বরমালার প্রথম সুরটা যে গাধার সুর হইতে চুরি এরূপ পরমাশ্চর্য কল্পনা কেমন করিয়া যে কোনো সুরজ্ঞ ব্যক্তির মনে উদয় হইল তাহা আমাদের পক্ষে স্থির করা দুরূহ।

ব্যোম কহিল–গ্রীকদের নিকট বহির্জগৎ বাষ্পবৎ মরীচিকাবৎ ছিল না, তাহা প্রত্যক্ষ জাজ্বল্যমান ছিল, এইজন্য অত্যন্ত যত্নসহকারে তাঁহাদিগকে মনের সৃষ্টির সহিত বাহিরের সৃষ্টির সামঞ্জস্য রক্ষা করিতে হইত। কোনো বিষয়ে পরিমাণ লঙ্ঘন হইলে বাহিরের জগৎ আপন মাপকাঠি লইয়া তাঁহাদিগকে লজ্জা দিত। সেইজন্য তাঁহারা আপন দেব-দেবীর মূর্তি সুন্দর এবং স্বাভাবিক করিয়া গড়িতে বাধ্য হইয়াছিলেন–নতুবা জাগতিক সৃষ্টির সহিত তাঁহাদের মনের সৃষ্টির একটা প্রবল সংঘাত বাধিয়া তাঁহাদের ভক্তির ও আনন্দের ব্যাঘাত করিত। আমাদের সে ভাবনা নাই। আমরা আমাদের দেবতাকে যে মূর্তিই দিই না কেন, আমাদের কল্পনার সহিত বা বহির্জগতের সহিত তাহার কোনো বিরোধ ঘটে না। মূষিকবাহন চতুর্‌ভুজ একদন্ত লম্বোদর গজানন মূর্তি আমাদের নিকট হাস্যজনক নহে, কারণ আমরা সেই মূর্তিকে আমাদের মনের ভাবের মধ্যে দেখি, বাহিরের জগতের সহিত, চারি দিকের সত্যের সহিত তাহার তুলনা করি না। কারণ, বাহিরের জগৎ আমাদের নিকট তেমন প্রবল নহে, প্রত্যক্ষ সত্য আমাদের নিকট তেমন সুদৃঢ় নহে, আমরা যে-কোনো একটা উপলক্ষ অবলম্বন করিয়া নিজের মনের ভাবটাকে জাগ্রত করিয়া রাখিতে পারি।

সমীর কহিল–যেটাকে উপলক্ষ করিয়া আমরা প্রেম বা ভক্তির উপভোগ অথবা সাধনা করিয়া থাকি, সেই উপলক্ষটাকে সম্পূর্ণতা বা সৌন্দর্য বা স্বাভাবিকতায় ভূষিত করিয়া তোলা আমরা অনাবশ্যক মনে করি। আমরা সম্মুখে একটা কুগঠিত মূর্তি দেখিয়াও মনে তাহাকে সুন্দর বলিয়া অনুভব করিতে পারি। মানুষের ঘননীলবর্ণ আমাদের নিকট স্বভাবত সুন্দর মনে না হইতে পারে, অথচ ঘননীলবর্ণে চিত্রিত কৃষ্ণের মূর্তিকে সুন্দর বলিয়া ধারণা করিতে আমাদিগকে কিছুমাত্র প্রয়াস পাইতে হয় না। বহির্জগতের আদর্শকে যাহারা নিজের ইচ্ছামতে লোপ করিতে জানে না, তাহারা মনের সৌন্দর্যভাবকে মূর্তি দিতে গেলে কখনোই কোনো অস্বাভাবিকতা বা অসৌন্দর্যের সমাবেশ করিতে পারে না। গ্রীকদের চক্ষে এই নীলবর্ণ অত্যন্ত অধিক পীড়া উৎপাদন করিত।

ব্যোম কহিল–আমাদের ভারতবর্ষীয় প্রকৃতির এই বিশেষত্বটি উচ্চ অঙ্গের কলাবিদ্যার ব্যাঘাত করিতে পারে, কিন্তু ইহার