কাব্যের তাৎপর্য

সমীর কহিল–ভালো করিয়া জীবন ধারণ করিবার বিদ্যাকে সঞ্জীবনী বিদ্যা বলা যাক। মনে করা যাক কোনো কবি সেই বিদ্যা নিজে শিখিয়া অন্যকে দান করিবার জন্য জগতে আসিয়াছে। সে তাহার সহজ স্বর্গীয় ক্ষমতায় সংসারকেবিমুগ্ধ করিয়া সংসারের কাছ হইতে সেই বিদ্যা উদ্ধার করিয়া লইল। সে যে সংসারকে ভালোবাসিল না তাহা নহে, কিন্তু সংসার যখন তাহাকে বলিল, তুমি আমার বন্ধনে ধরা দাও, সে কহিল, ধরা যদি দিই, তোমার আবর্তের মধ্যে যদি আকৃষ্ট হই তাহা হইলে এ সঞ্জীবনী বিদ্যা আমি শিখাইতে পারিব না; সংসারে সকলের মধ্যে থাকিয়াও আপনাকে বিচ্ছিন্ন রাখিতে হইবে। তখন সংসার তাহাকে অভিশাপ দিল, তুমি যে বিদ্যা আমার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছ সে বিদ্যা অন্যকে দান করিতে পারিবে, কিন্তু নিজে ব্যবহার করিতে পারিবে না। সংসারের এই অভিশাপ থাকাতে প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় যে, গুরুর শিক্ষা ছাত্রের কাজে লাগিতেছে, কিন্তু সংসারজ্ঞান নিজের জীবনে ব্যবহার করিতে তিনি বালকের ন্যায় অপটু। তাহার কারণ, নির্লিপ্তভাবে বাহির হইতে বিদ্যা শিখিলে বিদ্যাটা ভালো করিয়া পাওয়া যাইতে পারে, কিন্তু সর্বদা কাজের মধ্যে লিপ্ত হইয়া না থাকিলে তাহার প্রয়োগ শিক্ষা হয় না। সেইজন্য পুরাকালে ব্রাহ্মণ ছিলেন মন্ত্রী, কিন্তু ক্ষত্রিয় রাজা তাঁহার মন্ত্রণা কাজে প্রয়োগ করিতেন। ব্রাহ্মণকে রাজাসনে বসাইয়া দিলে ব্রাহ্মণও অগাধ জলে পড়িত এবং রাজ্যকেও অকূল পাথারে ভাসাইয়া দিত।

তোমরা যে-সকল কথা তুলিয়াছিলে সেগুলো বড়ো বেশি সাধারণ কথা। মনে করো যদি বলা যায়, রামায়ণের তাৎপর্য এই যে রাজার গৃহে জন্মিয়া অনেকে দুঃখ ভোগ করিয়া থাকে, অথবা শকুন্তলার তাৎপর্য এই যে উপযুক্ত অবসরে স্ত্রীপুরুষের চিত্তে পরস্পরের প্রতি প্রেমের সঞ্চার হওয়া অসম্ভব নহে, তবে সেটাকে একটা নূতন শিক্ষা বা বিশেষ বার্তা বলা যায় না।

স্রোতস্বিনী কিঞ্চিৎ ইতস্তত করিয়া কহিল–আমার তো মনে হয় সেইসকল সাধারণ কথাই কবিতার কথা। রাজগৃহে জন্মগ্রহণ করিয়াও, সর্বপ্রকার সুখের সম্ভাবনা-সত্ত্বেও, আমৃত্যুকাল অসীম দুঃখ রাম সীতাকে সংকট হইতে সংকটান্তরে ব্যাধের ন্যায় অনুসরণ করিয়া ফিরিয়াছে; সংসারের এই অত্যন্ত সম্ভবপর, মানবাদৃষ্টের এই অত্যন্ত পুরাতন দুঃখকাহিনীতেই পাঠকের চিত্ত আকৃষ্ট এবং আর্দ্র হইয়াছে। শকুন্তলার প্রেমদৃশ্যের মধ্যে বাস্তবিকই কোনো নূতন শিক্ষা বা বিশেষ বার্তা নাই, কেবল এই নিরতিশয় প্রাচীন এবং সাধারণ কথাটি আছে যে, শুভ অথবা অশুভ অবসরে প্রেম অলক্ষিতে অনিবার্য বেগে আসিয়া দৃঢ়বন্ধনে স্ত্রীপুরুষের হৃদয় এক করিয়া দেয়। এই অত্যন্ত সাধারণ কথা থাকাতেই সর্বসাধারণে উহার রসভোগ করিয়া আসিতেছে। কেহ কেহ বলিতে পারেন, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের বিশেষ অর্থ এই যে মৃত্যু এই জীবজন্তু-তরুলতা-তৃণাচ্ছাদিত বসুমতীর বস্ত্র আকর্ষণ করিতেছে, কিন্তু বিধাতার আশীর্বাদে কোনোকালে তাহার বসনাঞ্চলের অন্ত হইতেছে না, চিরদিনই সে প্রাণময় সৌন্দর্যময় নববস্ত্রে ভূষিত থাকিতেছে। কিন্তু সভাপর্বে যেখানে আমাদের হৃৎপিণ্ডের রক্ত তরঙ্গিত হইয়া উঠিয়াছিল এবং অবশেষে সংকটাপন্ন ভক্তের প্রতি দেবতার কৃপায় দুই চক্ষু অশ্রুজলে প্লাবিত হইয়াছিল, সে কি এই নূতন এবং বিশেষ অর্থ গ্রহণ করিয়া? না, অত্যাচারপীড়িত রমণীর লজ্জা ও সেই লজ্জা-নিবারণ-নামক অত্যন্ত সাধারণ স্বাভাবিক এবং পুরাতন কথায়? কচ-দেবযানী-সংবাদেও মানবহৃদয়ের এক অতি চিরন্তন এবং সাধারণ বিষাদকাহিনী বিবৃত আছে, সেটাকে যাঁহারা অকিঞ্চিৎকর জ্ঞান করেন এবং বিশেষ তত্ত্বকেই প্রাধান্য দেন তাঁহারা কাব্যরসের অধিকারী নহেন।

সমীর হাসিয়া আমাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন–শ্রীমতী স্রোতস্বিনী আমাদিগকে কাব্যরসের অধিকার-সীমা হইতে একেবারে নির্বাসিত করিয়া দিলেন, এক্ষণে স্বয়ং কবি কী বিচার করেন একবার শুনা যাক।

স্রোতস্বিনী অত্যন্ত লজ্জিত ও অনুতপ্ত হইয়া বারম্বার এই অপবাদের প্রতিবাদ করিলেন।

আমি কহিলাম–এই পর্যন্ত বলিতে পারি, যখন কবিতাটি লিখিতে বসিয়াছিলাম তখন কোনো অর্থই মাথায় ছিল না, তোমাদের কল্যাণে এখন দেখিতেছি লেখাটা বড়ো নিরর্থক হয় নাই–অর্থ অভিধানে কুলাইয়া উঠিতেছে না। কাব্যের একটা গুণ