পরিশিষ্ট
জ্ঞান কী আছে’, তোমাকে অনুরোধ করি, তুমি তোমার সমস্ত দর্শন বিজ্ঞান লইয়া মানবের এই পুরাতন প্রেমকে এমনি উজ্জ্বল মধুর ভাবে ব্যক্ত করো দেখি। যাহা কিছুতে ধরা দিতে চায় না সে মন্ত্রবলে ইহার মধ্যে ধরা দিয়াছে।

পূর্বেই বলিয়াছি বিজ্ঞানে দর্শনে আমরা জগৎকে জানি, কাব্যে আমরা আপনাকে জানি। অতএব যদি কোনো কবিতায় আমরা কেবলমাত্র এইটুকু জানি যে, ফুল আমরা ভালোবাসি, আকাশের তারা আমাদের হৃদয় আকর্ষণ করে, যে আমার প্রিয়জন সে আমার না-জানি-কী—যদি তাহাতে জগতের ক্রমবিকাশ বা কোনো ধর্মমতের উৎকর্ষ সম্বন্ধে কোনো কথা না’ও থাকে—তথাপি তাহাকে অসম্মান করা যায় না।

যদি বল ‘ইহার উপকার কী’, ইহার উপকারও আছে। আমরা যতক্ষণ আপনাকে আপনার মধ্যে বদ্ধ করিয়া দেখি ততক্ষণ আপনাকে পূরা জানি না। যখন সেই অঙ্গনের দ্বার উদ্‌ঘাটিত হয় তখনই আপন অধিকারের বিস্তার জানিতে পারি। যখনই একটি ক্ষুদ্র ফুল বাহিরে আমাকে টানিয়া লইয়া যায় তখনই আমি অসীমের দ্বারে গিয়া উপস্থিত হই। আমার প্রিয় মুখ যখন আমাকে আহ্বান করে তখন সে আমাকে আমার ক্ষুদ্রতা হইতে আহ্বান করে; যতই অধিক ভালোবাসি ততই আমার ভালোবাসার প্রাবল্যের মধ্যে আপনার বিপুলতা বুঝিতে পারি। প্রেমের মধ্যে সৌন্দর্যের মধ্যে হৃদয়ের বন্ধনমুক্তি হয়।

কিন্তু কাব্যপ্রসঙ্গে উপকারিতার কথা এইজন্য উত্থাপন করা যায় না যে, কাব্যের আনুষঙ্গিক ফল যাহাই হউক কাব্যের উদ্দেশ্য উপকার করিতে বসা নহে। যাহা সত্য যাহা সুন্দর তাহাতে উপকার হইবারই কথা, কিন্তু সেই উপকারিতার পরিমাণের উপর তাহার সত্যতা ও সৌন্দর্যের পরিমাণ নির্ভর করে না। সৌন্দর্য আমাদের উপকার করে বলিয়া সুন্দর নহে, সুন্দর বলিয়াই উপকার করে। উপকারিতাপ্রসঙ্গে কবিতাকে বিচার করিতে বসিলে সর্বদাই ভ্রমের সম্ভাবনা থাকিয়া যায়। কারণ, উপকার নানা উপায়ে হয়; কবিতার মধ্যে উপকার-অন্বেষণ যাহাদের স্বভাব তাহারা কাব্যের মধ্যে যে-কোনো উপকার পাইলেই চরিতার্থ হয়, বিচার করে না তাহা যথার্থ কাব্যের প্রকৃতিগত কি না। এমন অনেক পাঠক দেখা গিয়াছে যাহারা ছন্দোবদ্ধ অদৃষ্টবাদ অথবা অভিব্যক্তিবাদ সম্বন্ধে কোনো কথা পাইলেই আনন্দে ব্যাকুল হইয়া উঠে, মনে করে ইহাতে মানবের পরম উপকার হইতেছে। এবং তাহারা কোনো বিশেষ কবিতার সৌন্দর্য স্বীকার করিয়াও তাহার উপকারিতার অভাব লইয়া অপ্রসন্নতা প্রকাশ করিয়া থাকে। যেমন, ব্যবসায়ী লোক আক্ষেপ করে পৃথিবীর সমস্ত ফুলবাগান তাহার মূলার খেত হইল না কেন। সে স্বীকার করিবে ফুল সুন্দর বটে, কিন্তু কিছুতে বুঝিতে পারিবে না তাহাতে ফল কী আছে।

বাংলা সাহিত্যের প্রতি অবজ্ঞা

যাঁহারা অনেক ইংরাজি কেতাব পড়িয়াছেন তাঁহারা অনেকেই আধুনিক বাংলা লেখা ও লেখকদের প্রতি কৃপাকটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া থাকেন। এইরূপ অবজ্ঞা প্রকাশ করিয়া তাঁহারা অনেকটা আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। বোধ করি ইতরসাধারণ হইতে আপনাকে স্বতন্ত্র করিয়া লইয়া অভিমানে তাঁহারা আপাদমস্তক কণ্টকিত হইয়া উঠেন। একটা কথা ভুলিয়া যান যে, পৃথিবীতে বড়ো হওয়া শক্ত, কিন্তু আপনাকে বড়ো মনে করা সকলের চেয়ে সহজ। সমযোগ্য লোককে দূরে পরিহার করিয়া অনেকে স্বকপোলকল্পিত মহত্ত্বলাভ করে, কিন্তু প্রার্থনা করি এরূপ অজ্ঞানকৃত প্রহসন-অভিনয় হইতে আমাদের অন্তর্যামী আমাদিগকে সতত বিরত করুন।

বহুকাল হইতে বহুতর সামাজিক প্লাবনের সাহায্যে স্তর পড়িয়া ইংরাজি সাহিত্য উচ্চতা কঠিনতা এবং একটা নির্দিষ্ট আকার প্রাপ্ত হইয়াছে। আমাদের বাংলা সাহিত্যে সম্প্রতি পলি পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। ইহার কোথাও জলা, কোথাও বালি, কোথাও মাটি। সুতরাং ইহার বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে যে যাহা ইচ্ছা বলিতে পারে, কাহারো প্রতিবাদ করিবার সাধ্য নাই। ইহার ইতিহাস নাই, আবহমান-কাল-প্রচলিত প্রবাহ নাই, বহুকালসঞ্চিত রত্নভাণ্ডার নাই, ইহার বিক্ষিপ্ত অংশগুলিকে এখনো এক সমালোচনার নিয়মে