ছেলেবেলা

মুখখানিতে-ঘেরদেওয়া তাঁর শাড়িটি লালপেড়ে।

চুরি করে চাবির গোছা লুকিয়ে ফুলের টবে

স্নেহের রাগে রাগিয়ে দিতেম নানান উপদ্রবে।

কিশোরী চাটুজ্যে হঠাৎ জুটত সন্ধ্যা হলে,

বাঁ হাতে তার থেলো হুঁকো, চাদর কাঁধে ঝোলে।

দ্রুতলয়ে আউড়ে যেত লবকুশের ছড়া,

থাকত আমার খাতা লেখা, পড়ে থাকত পড়া ;

মনে মনে ইচ্ছে হত যদিই কোনো ছলে

ভরতি হওয়া সহজ হত এই পাঁচালির দলে,

ভাবনা মাথায় চাপত নাকো ক্লাসে ওঠার দায়ে,

গান শুনিয়ে চলে যেতুম নতুন নতুন গাঁয়ে।

স্কুলের ছুটি হয়ে গেলে বাড়ির কাছে এসে

হঠাৎ দেখি, মেঘ নেমেছে ছাদের কাছে ঘেঁষে।

আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে, রাস্তা ভাসে জলে,

ঐরাবতের শুঁড় দেখা দেয় জল-ঢালা সব নলে।

অন্ধকারে শোনা যেত রিম্‌ঝিমিনি ধারা,

রাজপুত্র তেপান্তরে কোথা সে পথহারা।

ম্যাপে যে-সব পাহাড় জানি, জানি যে-সব গাঙ

কুয়েন্‌লুন আর মিসিসিপি, ইয়াংসিকিয়াঙ —

জানার সঙ্গে আধেক-জানা, দূরের থেকে শোনা,

নানা রঙের নানা সুতোয় সব দিয়ে জাল-বোনা,

নানারকম ধ্বনির সঙ্গে নানান চলাফেরা

সব দিয়ে এক হালকা জগৎ মন দিয়ে মোর ঘেরা —

ভাবনাগুলো তারি মধ্যে ফিরত থাকি থাকি

বানের জলে শ্যাওলা যেমন, মেঘের তলে পাখি।

আমি জন্ম নিয়েছিলুম সেকেলে কলকাতায়। শহরে শ্যাকরাগাড়ি ছুটছে তখন ছড়্‌ছড়্‌ করে ধুলো উড়িয়ে, দড়ির চাবুক পড়ছে হাড়-বের করা ঘোড়ার পিঠে। না ছিল ট্রাম, না ছিল বাস, না ছিল মোটরগাড়ি। তখন কাজের এত বেশি হাঁসফাঁসানি ছিল না, রয়ে বসে দিন চলত। বাবুরা আপিসে যেতেন কষে তামাক টেনে নিয়ে পান চিবতে চিবতে, কেউ বা পালকি চড়ে কেউ বা ভাগের গাড়িতে। যাঁরা ছিলেন টাকাওয়ালা তাঁদের গাড়ি ছিল তকমা-আঁকা, চামড়ার আধঘোমটাওয়ালা, কোচবাক্সে কোচমান বসত মাথায় পাগড়ি হেলিয়ে, দুই দুই সইস থাকত পিছনে, কোমরে চামর বাঁধা, হেঁইয়ো শব্দে চমক লাগিয়ে দিত পায়ে-চলতি মানুষকে। মেয়েদের বাইরে যাওয়া-আসা ছিল দরজাবন্ধ পালকির হাঁপধরানো অন্ধকারে,গাড়ি চড়তে ছিল ভারি লজ্জা।রোদবৃষ্টিতে মাথায় ছাতা উঠত না। কোনো মেয়ের গায়ে সেমিজ,পায়ে জুতো,দেখলে সেটাকে বলত মেমসাহেবি;তার মানে,লজ্জাশরমের মাথা