কৃষ্ণচরিত্র

বঙ্কিম যদি কৃষ্ণকে দেবতা না মনে করিতেন এবং কৃষ্ণের সমস্ত চিত্তবৃত্তির সর্বাঙ্গীণ উৎকর্ষ সম্বন্ধে তাঁহার কোনোরূপ থিয়োরি না থাকিত তাহা হইলে এ-সমস্ত তর্ক-বিতর্কের কোনো প্রয়োজন থাকিত না, এবং তিনি সর্বত্র সংযম রক্ষা করিয়া চলিতে পারিতেন। তাহা হইলে তিনি নিরপেক্ষ নির্বিকারচিত্তে মহাভারতকার কবির আদর্শ কৃষ্ণকে অবিকলভাবে উদ্ধার করিয়া পাঠকদের সম্মুখে উপনীত করিতেন–এবং পাছে কোনো অবিশ্বাসী সংশয়ী পাঠক তাঁহার কৃষ্ণচরিত্রের কোনো অংশে তিলমাত্র অসম্পূর্ণতা দেখিতে পায় এজন্য আগেভাগে তাহাদের প্রতি রোষ প্রকাশ করিয়া তাঁহার গ্রন্থ হইতে উচ্চসাহিত্যের লক্ষ্যগত অচঞ্চল শান্তি দূর করিয়া দিতেন না।

যেমন প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চের উপরে নেপথ্যবিধান করিতে আরম্ভ করিলে অভিনয়ের রসভঙ্গ হয়, কাব্যসৌন্দর্য সমগ্রভাবে শ্রোতৃবর্গের মনের মধ্যে মুদ্রিত হয় না, সেইরূপ বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিত্রে পদে পদে তর্কযুক্তি বিচার উপস্থিত হইয়া আসল কৃষ্ণচরিত্রটিকে পাঠকের হৃদয়ে অখণ্ডভাবে প্রতিষ্ঠিত হইতে বাধা দিয়াছে। কিন্তু বঙ্কিম বলিতে পারেন, ‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রনথটি স্টেজ নহে; উহা নেপথ্য; স্টেজ-ম্যানেজার আমি নানা বাধাবিঘ্নের সহিত সংগ্রাম করিয়া, নানা স্থান হইতে নানা সাজসজ্জা আনয়নপূর্বক কৃষ্ণকে নরোত্তমবেশে সাজাইয়া দিলাম–এখন কোনো কবি আসিয়া যবনিকা উত্তোলন করিয়া দিন, অভিনয় আরম্ভ করুন, সর্বসাধারণের মনোহরণ করিতে থাকুন। তাঁহাকে শ্রমসাধ্য চিন্তাসাধ্য বিচারসাধ্য কাজ কিছুই করিতে হইবে না।