পল্লীগ্রামে
উঠিয়াছে–সমাজের সহিত তাহাদের সর্বপ্রকার বিচ্ছেদ দূর হইয়া তাহারা সমাজের অঙ্গ হইয়া গেছে, এই ঐক্যেই তাহাদের সৌন্দর্য। মানবসমাজে স্ত্রীলোক সর্বাপেক্ষা পুরাতন; পুরুষ নানা কার্য নানা অবস্থা নানা পরিবর্তনের মধ্যে সর্বদাই চঞ্চলভাবে প্রবাহিত হইয়া আসিতেছে; স্ত্রীলোক স্থায়িভাবে কেবলই জননী এবং পত্নীরূপে বিরাজ করিতেছে, কোনো বিপ্লবেই তাহাকে বিক্ষিপ্ত করে নাই; এইজন্য সমাজের মর্মের মধ্যে নারী এমন সুন্দররূপে সংহতরূপে মিশ্রিত হইয়া গেছে; কেবল তাহাই নহে, সেইজন্য সে তাহার ভাবের সহিত, কাজের সহিত, শক্তির সহিত, সবসুদ্ধ এমন সম্পূর্ণ এক হইয়া গেছে–এই দুর্লভ সর্বাঙ্গীণ ঐক্য লাভ করিবার জন্য তাহার দীর্ঘ অবসর ছিল।

সেইরূপ যখন দীর্ঘকালের স্থায়িত্ব আশ্রয় করিয়া তর্ক যুক্তি জ্ঞান ক্রমশ সংস্কারে বিশ্বাসে আসিয়া পরিণত হয় তখনই তাহার সৌন্দর্য ফুটিতে থাকে। তখন সে স্থির হইয়া দাঁড়ায় এবং ভিতরে যে-সকল জীবনের বীজ থাকে সেইগুলি মানুষের বহুদিনের আনন্দালোকে ও অশ্রুজলবর্ষণে অঙ্কুরিত হইয়া তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে।

য়ুরোপে সম্প্রতি যে এক নব সভ্যতার যুগ আবির্‌ভূত হইয়াছে এ যুগে ক্রমাগতই নব নব জ্ঞানবিজ্ঞান মতামত স্তূপাকার হইয়া উঠিয়াছে; যন্ত্রতন্ত্র উপকরণসামগ্রীতেও একেবারে স্থানাভাব হইয়া দাঁড়াইয়াছে। অবিশ্রাম চাঞ্চল্যে কিছুই পুরাতন হইতে পাইতেছে না।

কিন্তু দেখিতেছি এই-সমস্ত আয়োজনের মধ্যে মানবহৃদয় কেবলই ক্রন্দন করিতেছে, য়ুরোপের সাহিত্য হইতে সহজ আনন্দ সরল শান্তির গান একেবারে নির্বাসিত হইয়া গিয়াছে। হয় প্রমোদের মাদকতা, নয় নৈরাশ্যের বিলাপ, নয় বিদ্রোহের অট্টহাস্য।

তাহার কারণ, মানবহৃদয় যতক্ষণ এই বিপুল সভ্যতাস্তূপের মধ্যে একটি সুন্দর ঐক্য স্থাপন করিতে না পারিবে ততক্ষণ কখনোই ইহার মধ্যে আরামে ঘরকন্না পাতিয়া প্রতিষ্ঠিত হইতে পারিবে না। ততক্ষণ সে কেবল অস্থির অশান্ত হইয়া বেড়াইবে। আর-সমস্তই জড়ো হইয়াছে, কেবল এখনো স্থায়ী সৌন্দর্য–এখনো নব সভ্যতার রাজলক্ষ্মী–আসিয়া দাঁড়ান নাই। জ্ঞান বিশ্বাস ও কার্য পরস্পরকে কেবলই পীড়ন করিতেছে-ঐক্যলাভের জন্য নহে, জয়লাভের জন্য পরস্পরের মধ্যে সংগ্রাম বাধিয়া গিয়াছে।

কেবল যে প্রাচীন স্মৃতির মধ্যে সৌন্দর্য তাহা নহে, নবীন আশার মধ্যেও সৌন্দর্য; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে য়ুরোপের নূতন সভ্যতার মধ্যে এখনো আশার সঞ্চার হয় নাই। বৃদ্ধ য়ুরোপ অনেকবার অনেক আশায় প্রতারিত হইয়াছে; যে-সকল উপায়ের উপর তাহার বড়ো বিশ্বাস ছিল সে-সমস্ত একে একে ব্যর্থ হইতে দেখিয়াছে। ফরাসি বিপ্লবকে একটা বৃহৎ চেষ্টার বৃথা পরিণাম বলিয়া অনেকে মনে করে। এক সময় লোকে মনে করিয়াছিল আপামর সাধারণকে ভোট দিতে দিলেই পৃথিবীর অধিকাংশ অমঙ্গল দূর হইবে–এখন সকলে ভোট দিতেছে, অথচ অধিকাংশ অমঙ্গল বিদায় লইবার জন্য কোনোরূপ ব্যস্ততা দেখাইতেছে না। কখনো বা লোকে আশা করিয়াছিল স্টেটের দ্বারা মানুষের সকল দুর্দশা মোচন হইতে পারে, এখন আবার পণ্ডিতেরা আশঙ্কা করিতেছেন স্টেটের দ্বারা দুর্দশা মোচনের চেষ্টা করিলে হিতে বিপরীত হইবারই সম্ভাবনা। কয়লার খনি, কাপড়ের কল এবং বিজ্ঞানশাস্ত্রের উপর কাহারও কাহারও কিছু কিছু বিশ্বাস হয়, কিন্তু তাহাতেও দ্বিধা ঘোচে না; অনেক বড়ো বড়ো লোক বলিতেছেন, কলের দ্বারা মানুষের পূর্ণতা সাধন হয় না। আধুনিক য়ুরোপ বলে, আশা করিয়ো না, বিশ্বাস করিয়ো না, কেবল পরীক্ষা করো।

নবীনা সভ্যতা যেন এক বৃদ্ধ পতিকে বিবাহ করিয়াছে, তাহার সমৃদ্ধি আছে, কিন্তু যৌবন নাই; সে আপনার সহস্র পূর্ব অভিজ্ঞতার দ্বারা জীর্ণ। উভয়ের মধ্যে ভালোরূপ প্রণয় হইতেছে না, গৃহের মধ্যে কেবল অশান্তি।

এই-সমস্ত আলোচনা করিয়া আমি এই পল্লীর ক্ষুদ্র সম্পূর্ণতার সৌন্দর্য দ্বিগুণ আনন্দে সম্ভোগ করিতেছি।
তাই বলিয়া আমি এমন অন্ধ নহি যে, য়ুরোপীয় সভ্যতার মর্যাদা বুঝি না। প্রভেদের মধ্যে ঐক্যই ঐক্যের পূর্ণ আদর্শ–বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই সৌন্দর্যের প্রধান কারণ। সম্প্রতি য়ুরোপে সেই প্রভেদের যুগ পড়িয়াছে, তাই বিচ্ছেদ, বৈষম্য। যখন ঐক্যের যুগ আসিবে তখন