অরসিকের স্বর্গপ্রাপ্তি
আমি করে যেতে পারি তা হলে স্বর্গের এ চেহারা আর থাকে না। যাঁরা-সব দেবতাদের ঘুষ দিয়ে দিয়ে স্বর্গে আসেন, প্রতি সংখ্যায় তাঁদের যদি একটি করে সংক্ষেপ-মর্তজীবনী বের করতে পারি তা হলে আমাদের স্বর্গীয় মহাত্মাদের মধ্যে একটা সেন্‌সেশন পড়ে যায়। একবার ইন্দ্রের কাছে আমার প্রস্তাবগুলো পেড়ে দেখতে হবে।

(ইন্দ্রের নিকট গিয়া) দেখুন মহেন্দ্র, আপনার সঙ্গে আমার গোপনে কিছু (অপ্সরাগণকে দেখিয়া) ও! আমি জানতুম না এঁরা সব এখানে আছেন— মাপ করবেন— আমি যাচ্ছি। একি, শচীঠাকরুনও যে বসে আছেন! আর, ঐ বুড়ো বুড়ো রাজর্ষি-দেবর্ষিগুলোই বা এখানে বসে কী দেখছে! দেখুন মহেন্দ্র, স্বর্গে স্বায়ত্তশাসন-প্রথা প্রচলিত করেন নি বলে এখানকার কাজকর্ম তেমন ভালো রকম করে চলছে না। আপনি যদি কিছুকাল এই-সমস্ত নাচ-বাজনা বন্ধ করে দিয়ে আমার সঙ্গে আসেন তা হলে আমি আপনাকে হাতে হাতে দেখিয়ে দিতে পারি এখানকার কোনো কাজেরই বিলিব্যবস্থা নেই। কার ইচ্ছায় কী করে যে কী হচ্ছে কিছুই দন্তস্ফুট করবার জো নেই। কাজ এমনতরো পরিষ্কার ভাবে হওয়া উচিত যে, যন্ত্রের মতো চলবে এবং চোখ বুলিয়ে দেখবামাত্রই বোঝা যাবে। আমি সমস্ত নিয়ম নম্বরওয়ারি করে লিখে নিয়ে এসেছি; আপনার সহস্র চক্ষুর মধ্যে একজোড়া চোখও যদি এ দিকে ফেরান তা হলে— আচ্ছা, তবে এখন থাক্‌, আপনাদের গান-বাজনাগুলো নাহয় হয়ে যাক, তার পরে দেখা যাবে।

(ভরত ঋষির প্রতি) আচ্ছা, অধিকারীমশায়, শুনেছি গান-বাজনায় আপনি ওস্তাদ, একটি প্রশ্ন আপনার কাছে আছে। গানের সম্বন্ধে যে ক'টি প্রধান অঙ্গ আছে, অর্থাৎ সপ্ত সুর, তিন গ্রাম, একুশ মূর্ছনা— কী বললেন? আপনারা এ-সমস্ত মানেন না? আপনারা কেবল আনন্দটুকু জানেন! তাই তো দেখছি— এবং যত দেখছি তত অবাক হয়ে যাচ্ছি। ( কিয়ৎক্ষণ শুনিয়া) ভরতঠাকুর, ঐ-যে ভদ্রমহিলাটি— কী ওঁর নাম— রম্ভা? উপাধি কী বলুন। উপাধি বুঝছেন না? এই যেমন রম্ভা চাটুজ্জে কি রম্ভা ভট্টাচার্য, কিংবা ক্ষত্রিয় যদি হন তো রম্ভা সিংহ—এখানে আপনাদের ও-সব কিছু নেই বুঝি? আচ্ছা, বেশ কথা, তা, শ্রীমতী রম্ভা যে গানটি গাইলেন আপনারা তো তার যথেষ্ট প্রশংসা করলেন; কিন্তু ওর রাগিণীটি আমাকে অনুগ্রহ করে বলে দেবেন? একবার তো দেখছি ধৈবত লাগছে, আবার দেখি কোমল ধৈবতও লাগে, আবার গোড়ার দিকে— ওঃ, বুঝেছি, আপনাদের কেবল ভালোই লাগে, কিন্তু ভালো লাগবার কোনো নিয়ম নেই। আমাদের ঠিক তার উলটো, ভালো না লাগতে পারে, কিন্তু নিয়মটা থাকবেই। আপনাদের স্বর্গে যেটি আবশ্যক সেটি নেই, যেটা না হলে চলে তার অনেক বাহুল্য। সমস্ত সপ্তস্বর্গ খুঁজে কায়ক্লেশে যদি আধখানা নিয়ম পাওয়া যায় তো তখনি তার হাজারখানা ব্যতিক্রম বেরিয়ে পড়ে। সকল বিষয়েই তাই দেখছি। ঐ দেখুন-না ষড়ানন বসে আছেন, ওঁর ছটার মধ্যে পাঁচটা মুণ্ডুর কোনোই অর্থ পাবার জো নেই। শরীরতত্ত্বের ক-খও যে জানে সেও বলে দিতে পারে একটা স্কন্ধের উপরে ছটা মুণ্ডু নিতান্তই বাহুল্য। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! ওঁর ছয় মাতার স্তন পান করতে ওঁকে ছটা মুণ্ড ধারণ করতে হয়েছিল? ওটা হল মাইথলজি, আমি ফিজিয়লজির কথা বলছিলুম। ছটা যেন মুণ্ডই ধারণ করলেন, পাকযন্ত্র তো একটার বেশি ছিল না। এই দেখুন-না, আপনাদের স্বর্গের বন্দোবস্তটা— আপনারা শরীর থেকে ছায়াটাকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু সেটা আপনাদের কী অপরাধ করেছিল? আপনারা স্বর্গের লোক, বললে হয়তো বিশ্বাস করেন না, আমি জন্মকাল থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত ঐ ছায়াটাকে কখনো পশ্চাতে, কখনো সম্মুখে, কখনো দক্ষিণে, কখনো বামে সঙ্গে করে নিয়ে কাটিয়েছি, ওটাকে পুষতে একদিনের জন্যে সিকিপয়সা খরচ করতে হয় নি এবং অত্যন্ত শ্রান্তির সময়ও বহন করতে এক তিল ভার বোধ করি নি— ওটাকে আপনারা ছেঁটে দিলেন, কিন্তু ছটা মুণ্ড, চারটে হাত, হাজারটা চোখ, এতে খরচও আছে, ভারও আছে, অথচ সেটা সম্বন্ধে একটু ইকনমি করবার দিকে নজর নেই! ছায়ার বেলাই টানাটানি, কিন্তু কায়ার বেলা মুক্তহস্ত! সাধুবাদ দিচ্ছেন? দেবতাদের মধ্যে আপনিই তা হলে আমার কথাটা বুঝেছেন! সাধুবাদ আমাকে দিচ্ছেন না? শ্রীমতী রম্ভাকে দিচ্ছেন? ওঃ! তা হলে আপনি বসুন, আমি কার্তিকের সঙ্গে আলাপ করে আসি।