গোড়ায় গলদ

বিনোদবিহারী। না, আমি তাকে দেখতে চাইনে। মনে করো আমি কেবল ওই গানকেই বিয়ে করছি। গান তো দৃষ্টিগোচর নয়।

চন্দ্রকান্ত। বিনু, এ কথাটা তোর মুখেও একটু বাড়াবাড়ি শোনাচ্ছে। কেবল গান বিয়ে করতে চাস তো একটা আর্গিন কেন্‌-না? এ-যে ভাই মানুষ, বড়ো সহজ জন্তু নয়! এ যেমন গান গাইতে পারে তেমনি পাঁচকথা শুনিয়ে দিতেও পারে। একই কণ্ঠ থেকে দু রকম বিপরীত সুর বের করতে পারে। গানটি পেতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে আস্ত স্ত্রীলোকটিকেও নিতে হয় এবং তাঁকে নিতে গেলেই একটু দেখেশুনে নেওয়া ভালো।

বিনোদবিহারী। না ভাই, আসল রত্নটুকুর অনুসন্ধান পাওয়া গেছে, এখন চোখ-কান বুজে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আহা, একবার ভেবে দেখো দেখি চন্দ্র, প্রত্যেক দিনটির সঙ্গে সকাল-সন্ধে দুটি-একটি করে তেমন-তেমন মিষ্টি সুর যদি লাগে, তা হলে জীবনের এক-একটা দিন এক-এক পাত্র মদের মতো এক চুমুকে নিঃশেষ করে ফেলা যায়—

চন্দ্রকান্ত। এখন বুঝি কেবল মুখ সিট্‌কে চিরেতা খাচ্ছিস?

বিনোদবিহারী। তা নয় তো কী। তুমি যে দেখে নিতে বলছ, দেখব কাকে। মানুষ কি চোখ চাইলেই দেখা যায়। দৈবাৎ হাতে ঠেকে। তুমিও যেমন! রাখো জীবনটা বাজি—চক্ষু বুজে দান তুলে নাও, তার পর হয় রাজা নয় ফকির—একেই তো বলে খেলা।

চন্দ্রকান্ত। উঃ! কী সাহস! তোমার কথা শুনলে আমার মতো মরচে-পড়া বিবাহিত লোকেরাও বুক সাত হাত হয়ে ওঠে—ফের আর-একটা বিয়ে করতে ইচ্ছে করে। সত্যি, তোমাদের দেখে হিংসে হয়। একেবারে আঠারো-আনা কবিত্ব করে নিলে হে! না দেখে বিয়ে তো আমরাও করেছি কিন্তু তার মধ্যে এমনতরো নেশা ছিল না। এ যে একেবারে দেখতে-না-দেখতে এক মুহূর্তে ভোঁ হয়ে উঠল!

নিমাই। তা বলি, বিয়ে যদি করতে হয় নিজে না দেখে করাই ভালো। যেমন ডাক্তারের পক্ষে নিজের কিংবা আত্মীয়ের চিকিৎসে করাটা কিছু নয়। কিন্তু বন্ধুবান্ধবদের দেখে শুনে নেওয়া উচিত। মেয়েটি কে বলো তো হে চন্দরদা!

চন্দ্রকান্ত। আমাদের নিবারণবাবুর বাড়িতে থাকেন, নাম কমলমুখী। আদিত্যবাবু আর নিবারণবাবু পরমবন্ধু ছিলেন। আদিত্য মরবার সময় মেয়েটিকে নিবারণবাবুর হাতে সমর্পণ করে দিয়ে গেছেন। নিবারণবাবু লোকটি কিছু নতুন ধরনের। যেমন কাঁচাপাকা মাথা, তেমনি কাঁচাপাকা স্বভাবের মানুষটিও। অনেক বিষয়ে সেকেলে অথচ অনেকগুলো একেলে ভাবও আছে। মেয়েটির বয়স হয়েছে, শুনেছি লেখাপড়াও কিছু অতিরিক্ত রকম শেখানো হয়েছে। বিনু যখন মুখনাড়া খাবেন তার মধ্যে ব্যাকরণের ভুল বের করতে পারবেন না। মনে করো, আমার গৃহিণী যখন উক্ত কার্যে প্রবৃত্ত হন তখন প্রায়ই তাঁর দুটো-চারটে গ্রাম্যতা-দোষ সংশোধন করে দিতে হয়, কিন্তু—

নিমাই। যাই হোক, একবার দেখে আসতে হচ্ছে।

বিনোদবিহারী। খেপেছ নিমাই! সে তো আর কচি মেয়ে নয় যে, কটি দাঁত উঠেছে গুনতে যাবে কিংবা বর্ণপরিচয়ের পরীক্ষা নেবে।

নিমাই। তা বটে, গিয়ে নিজেই অপ্রতিভ হয়ে বসে থাকতে হবে, ভয় হবে পাছে আমাকেই একজামিন করে বসে।

বিনোদবিহারী। আচ্ছা, একটা বাজি রাখা যাক। কী রকম তাকে দেখতে। গান শুনে আমার মনে একটা চেহারা উঠেছে —রঙ গৌরবর্ণ, পাতলা শরীর, চোখ দুটি খুব চঞ্চল, উজ্জ্বল হাসি এবং কথা মুখে বাধে না। চুল খুব যে বড়ো তা নয় কিন্তু কুঁকড়ে কুঁকড়ে মুখের চার দিকে পড়েছে!

নিমাই। আচ্ছা, আমি বলছি সে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, দোহারা আকৃতি, বেশ ধীর সুগম্ভীর ভাব, বড়ো বড়ো স্থির চক্ষু, বেশি কথা